এই নগরীর দিনরাত্রিঃ উৎসবের অনুষঙ্গ নেই by রেজোয়ান সিদ্দিকী

ই নগরীতে উত্সবের অনুষঙ্গ খুব বেশি নেই। দৈনন্দিন চিত্তবিনোদনের কোনো আয়োজন নেই। খোলা মাঠ নেই। নিরিবিলি নেই। চারদিকে উপচেপড়া মানুষের ভিড়। আর এই মানুষ যত বাড়ছে ততই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে খোলা চত্বরগুলো। পুকুর, জলাভূমি, মাঠ, সবকিছু উচ্ছেদ করে গড়ে উঠছে আবাসিক ভবন, বিপণি বিতান।
এই নগরীর বয়স্করা তাই চার দেয়ালের ঘর থেকে চার দেয়ালের অফিসে আবদ্ধ। এক ধরনের বন্দি জীবন তারা মেনেই নিয়েছে। শিশুরা বেড়ে উঠছে খাঁচায় পোষা ব্রয়লারের মতো। দু’চারটা স্কুল ছাড়া অধিকাংশ স্কুলেরই খেলার মাঠ নেই। ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া করে তার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্কুল-কলেজ। বয়স্করা তবু ঘর থেকে বের হতে পারে। শিশুদের সে স্বাধীনতাও নেই। ঘর থেকে এক পাও বাইরে দেয়ার সুযোগ নেই। কেবলই নিষেধের না।
তারা এই নগরীতে জনমবন্দি শিশু। তার বিনোদনের জগত্ টেলিভিশন বা কম্পিউটার। টিভিতে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। ভিডিও গেমসে যুদ্ধ, অস্ত্র, গোলাবারুদের কারবার। হত্যা, প্রতিপক্ষকে গুলি করে দিয়ে জেতার মধ্যে স্কোর। এভাবে আমরা বড় করে তুলছি আমাদের শিশুদের। ফলে ছোট শিশু পিতা-মাতার কাছে আবদার করে, ‘বাবা দোকানে যাচ্ছ? আমার জন্য একটি খেলার মাঠ কিনে এনো।’ অথচ এই শিশুদের কাছেই আমাদের অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা। যাকে আমরা খেলার মাঠ দিতে পারি না, যাকে আমরা উদার আকাশ দিতে পারি না, যাকে নির্মল বায়ু দিতে পারি না, স্রোতস্বিনী নদী দিতে পারি না, সমুদ্রের বিশালত্ব দিতে পারি না, পাহাড়ের মৌনতা দিতে পারি না, তার কাছে কেবলই চাইতে থাকি। সে বিরাট পণ্ডিত হবে, রেজাল্টে শীর্ষে থাকবে, তার মনে কোনো সঙ্কীর্ণতা থাকবে না, সে হবে অনুকরণীয় মানুষ।
সে কারণেই দেখা যায় ঈদে-পার্বণে গ্রামের বাড়িতে গেলে শিশুরা সহজে ফিরতে চায় না। কারণ, সেখানে এখনও খোলা আকাশ আছে, সবুজ-শ্যামল বর্ণালী বিশাল শস্য ক্ষেত আছে, মুক্ত বায়ু আছে। সাধারণ নিষেধের না নেই। চার দেয়ালের বন্দিত্ব নেই। পরাধীনতা নেই। স্বাধীনতা আছে। পারস্পরিক কুশল বিনিময় আছে। সেখানে ঘর থেকে বের হতে চাইলে শাসনের রক্তচক্ষু ঝলসে ওঠে না। হাত ধরে কাউকে রাস্তা পার করতে হয় না। দিগন্তের দিকে ঝেরে ছুট দেয়া যায়। নগর এ সবকিছু থেকেই শিশুদের বঞ্চিত করেছে। বঞ্চিত করেই যাচ্ছে। ফলে তাদের মন-মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন। এখানে শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ কেবলই বিনষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় বেড়ে ওঠা শিশুরা ভিন্ন এক সঙ্কীর্ণ গণ্ডিবদ্ধতায় দিন পার করছে। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার কোনো পরিবেশই আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।
সামগ্রিকভাবে উত্সবে অনুষঙ্গ কমে যাওয়ায় নগর প্রতিনিয়তই কারাগারে পরিণত হচ্ছে। এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা বছরে কদাচিত্ ঘটে। ছোটদের নিয়ে কাথাও হুট করে ঘুরে আসার সুযোগও কম। একদিকে বন্দিত্ব অপরদিকে কোচিং টিউটোরিয়াল মডেল টেস্টের গুরুভারে ভারাক্রান্ত শিশু। কিন্তু নগর পালক ও সমাজ তাত্ত্বিকদের দায়িত্ব এখানে অনেক। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বও সবাইকে নিতে হবে। সে সুযোগ অতি সামান্যই আছে।
কখনও কখনও সন্তানের হাত ধরে মুক্ত বায়ুর সন্ধানে রাস্তায় বের হয়ে আসে। ফলে শিশুপার্কগুলো, উদ্যানগুলো, খোলা চত্বরগুলো লোকে লোকারণ্যই হয়ে ওঠে। সে আরেক বিড়ম্বনা। তখন চিত্তবিনোদনের চেয়ে শিশুকে সামলে রাখাই দায় হয়ে পড়ে। আরও শক্ত করে ধরে রাখতে হয় হাত। মুক্তির বদলে তারা সবাই জনারণ্য দেখে। মানুষের চাপে ঘরে-বাইরে এসেও বয়স্ক বা শিশুরা হাঁসফাঁস করতে থাকে। আনন্দের বদলে তখন শঙ্কাই বড় হয়ে ওঠে।
এভাবেই পরিকল্পনাহীন ব্যবস্থায় নগরী বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন মাটি ফুঁড়ে নতুন দালান-কোঠা গজিয়ে উঠছে। আবাসনের নামে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ, খোলা চত্বর, সবুজ বৃক্ষরাজি, নীল আকাশ। আর আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের চিত্তবিনোদনের যাবতীয় অনুষঙ্গ। কেউ কি কোথাও আছেন? যিনি এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় বের করতে পারেন? তেমন দেবদূতের স্বতন্ত্র নগর পলক ও নগর পরিকল্পকদের অপেক্ষায় আছি।
পাতারা ঝরে যায়
এবার পৌষ আসার অনেক আগেই শীত শুরু হয়ে গেছে। হেমন্তেও খুব একটা বৃষ্টিপাত হয়নি। ফলে মাটি ক্রমেই শুষ্ক হয়ে উঠেছে। এটাই নিয়ম। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের প্রকৃতি একই নিয়ম অনুসরণ করে চলছে। আকাশ ভেঙে নেমে আসা পানি অন্যান্য ঋতুতে আমাদের জমিকে সিক্ত করে দিয়ে গেছে। ফলে উর্বর আন্ত থেকেছে জমি। এখন কিছুই নেই। বৃষ্টি নেই। ভূউপরিভাগের পানির সঙ্কট। সেচের নামে ভূ-গর্ভস্থ পানি টেনে তুলে আমরা সে উত্সও প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছি। নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি পূর্ণ সঞ্চায়িত হতে পারছে না। ফলে বৃক্ষের শিকড়ে জলের অভাব, এ অভাব আগেও ছিল। কিন্তু মানুষের খামখেয়ালি, প্রকৃতির ওপর নির্মম নিপীড়ন সে অবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। পানি নেই বৃক্ষের শিকড়ে।
আমরা যে শুরুতেই বলেছি, পাতারা ঝরে যায়, আসলেই কি পাতারা ঝরে যায়? পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীর মতোই প্রাণবান বৃক্ষের সদা কর্মতত্পর পাতাদের কেউই ঝরে যেতে চায় না। মানুষেরও যেমন নিয়ম পত্রালিরও একই নিয়ম। ঝরে যেতেই হয়। সেক্ষেত্রে বৃক্ষের সবচেয়ে প্রবীণ পাতা সব সময় যে ঝরে যায় এমন নিয়ম নেই। অন্য প্রাণীর মতোই সবচেয়ে তরুণ পাতাটিও সবার আগে ঝরে যেতে পারে। কে কখন ঝরে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গাছের পাতারা সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে দিবালোকে যেমন অক্সিজেনের সরবরাহ ঘটায় তেমনি একেকটি পাতা একেকটি চিনির কারখানা। পাতারা বৃক্ষের পুষ্টির জন্য অবিরাম চিনি উত্পাদন করে বৃক্ষকে সরবরাহ করে। কিন্তু এই পাতাদের টিকিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষের শিকড়ে পানি চাই। কিন্তু শীতকালে যে পানি নেই। বৃক্ষের নিজেকেও টিকে থাকতে হবে যদি সে টিকতেও পারে তাহলে চিনির সরবরাহের জন্য গ্রীষ্মের শুরুতেই আবারও পত্রালির জন্ম দিতে পারবে। এখন ঝরিয়ে দেয়ার পালা। সুতরাং বৃক্ষকে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শিকড়ে শিকড়ে পানি টেনে একদিন যে পত্রালীতে সে বিস্তৃত করেছিল নিজের অবয়বকে, নিজেকে সাজিয়ে ছিল ঘন পত্রপল্লবে তাদের ঝরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মা বৃক্ষ কাকে ঝরিয়ে দেবে, সবাই যে তার নিজেরই সন্তান। কিন্তু উপায় থাকে না। পানির সরবরাহ যেহেতু নেই, নিজের অস্তিত্বও যেহেতু টিকিয়ে রাখতে হবে, তাই এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় বৃক্ষরাজি। যেসব পাতাকে সে ঝরিয়ে দিতে চায়, সেসব পাতায় গোড়ায় গোড়ায় কর্ক-ক্যামরিয়াম বা অতি সূক্ষ্ম কাঠের স্তর গড়ে তোলে বৃক্ষ। তারপর এক সময় পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পানির সরবরাহ বন্ধ হয় বলে অনিবার্য পরিণতিতে মৃত্যুবরণ করতে হয় একেকটি পাতাকে। এভাবে বৃক্ষ লাখ লাখ পাতা ঝরিয়ে দেয়। যে দু’চারটে না হলেই নয় সেরকম কিছু কিছু পাতা রেখে বাকি সবার পানির বরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে বৃক্ষের শর্করার সঙ্কট হয়। কিন্তু টিকে থাকাই যেহেতু মূল সমস্যা, স্বাস্থ্য পুষ্টি সেখানে বড় কথা নয়। পাতা ঝরে যায়, তখন ঝরা পাতার গাছগুলো কৃশ বিবর্ণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনোমতেই নিজের অস্তিত্বই ঘোষণা করে।
পাতা ঝরিয়ে দিয়ে বৃক্ষও কি মানুষের মতো শোকে-বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে? হয়তো পড়ে। কিন্তু সে অনুভূতি মানুষকে জানাবার ভাষা বৃক্ষের তো নেই। যার যায় সেই শুধু বোঝে কতটা ক্ষরণ থাকে তার হৃদয়ের ভেতরে। এভাবে শোকগ্রস্ত বৃক্ষ সন্তান হারিয়ে পত্র-পল্লবহীন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা তার বেদনার কিছুই বুঝতে পারি না।
নগরমুখী মানুষের ঢল
কয়েকদিন আগে এক সহযোগী খবর দিয়েছে ‘ঢাকায় মানুষ আর মানুষ।’ ঢাকা এখন শুধু মানুষের শহর। শত শত লাখ লাখ মানুষে ঢাকা শহর গিজ গিজ করছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রিপোর্ট জানিয়েছে, এই নগরীতে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় থাকে ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ। প্রতি বছর রাস্তায় নামে নতুন ৩৬ হাজার ৫০০টি গাড়ি। প্রতিদিন ঢাকায় লোক আসে হাজারে হাজারে। তাদের অনেকেই চলে যায়। কিন্তু কমপক্ষে দৈনিক ২ হাজার ১৩৬ জন মানুষ ঢাকায় স্থায়ীভাবে রয়ে যায়। এভাবে মানুষ বাড়ছে।
বাড়বার বোধহয় আরও কিছু কারণ আছে। আর তা হলো দেশের সেরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকায়। সরকারি সব মন্ত্রণালয় অধিদফতর বিভাগের প্রধান কার্যালয় এমনকি বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানও এই নগরে। প্রধান প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতাল ঢাকায়। ব্যাংক-বীমাসহ সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও ঢাকায়। ঢাকার চারপাশে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের শিল্পকারখানা। ফলে ঢাকার দিকে অনিরুদ্ধ জনস্রোত। এছাড়া সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮২টি। এর মধ্যে সাতটিই ঢাকায়। ৩৮টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৩২টি ঢাকায়। ফলে ঢাকা ছাড়া কী উপায়। অথচ ১৯৮০ সালে এই নগরীর জনসংখ্যা ছিল ৩২ লাখ। এ হারে চলতে থাকলে ২০১৫ সালে এই নগরীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৭৯ লাখ। তখন যে এই নগরীর দুর্দশা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে সেটা অনুমান করাও কঠিন।
শুধু কর্ম-শিক্ষা-চিকিত্সার জন্যই মানুষ যে ঢাকার দিকে ছুটে আসছে এমনও নয়। ছুটে আসছে অভাবের তাড়নায়। দরিদ্র-কর্মহীন মানুষের বদ্ধমূল ধারণা আছে ঢাকায় গেলে একটা কিছু হবেই। এখন সারা দেশে কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংকুচিত এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ। ফলে সরকারিভাবেও কাজের সুযোগ এখন সঙ্কুচিত। তাই কাজের আশায় ঢাকায় ছুটে আসছে মানুষ।
এই শীতের রাতেও এখন পথে পথে বাস্তুহীন মানুষের ভিড়। কেউ কেউ ছিন্ন কাঁথায় শরীর মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। এসব মানুষ কেউ রিকশা চালায়, কেউ দিনমজুরি করে। কেউ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কেউ অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ভিক্ষায় নামে। পথের মোড়ে মোড়ে এখন ভিক্ষুকের ভিড়। ট্র্যাফিক পয়েন্টে গাড়ি থামলেই ডজন ডজন ভিক্ষুক এসে গাড়ির কাচে টোকা দেয়। তার মধ্যে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই আছে। যদি ভিক্ষা না পায় তাহলে এদেরও অনেকে জড়িয়ে যেতে পারে অপরাধের সঙ্গে। সে ভার বহিবার ক্ষমতা কি এই নগরীর আছে।
ফুটনোট
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমার এক তরুণ বন্ধু ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘আপনি এখন কোথায়।’ আমি বললাম, ‘আর বলবেন না, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে প্রেসক্লাব রওনা হয়েছি। ১ ঘণ্টা ৫ মিনিটে শাহবাগ পৌঁছলাম।’ বন্ধুটি রাগত স্বরে বললেন, ‘ঢাকা শহরের এ অবস্থার জন্য আমার বাপ আর আপনি দায়ী’। আমি জানতে চাইলাম ‘কেন’। তিনি জবাবে বললেন, ‘আপনারা ঢাকায় এসেছিলেন, লেখাপড়া করেছেন, চাকরি-বাকরি করেছেন। তারপর আর গ্রামে ফিরে যাননি। আপনারা ঢাকায় রয়ে গেছেন বলেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.