ইতিউতি-শরতের আকাশেও দুর্ভাবনার কালো মেঘ by আতাউস সামাদ

বাংলাদেশিরা কি খুবই আবেগপ্রবণ? নাকি আমরা কল্পনাবিলাসী, ভ্রান্তিপ্রেমী, চটুল অথবা বোকা? বোধ হয় একটু বেশি বলা হয়ে গেল। কারণ এ দেশের সবাই তো আর একরকম নয়। আমরা প্রত্যেকেই যদি কল্পনার জগতে ডুবে থাকি অথবা সবাই যদি বুদ্ধি-পরিত্যক্ত হয়ে থাকি বা নিষ্কর্মা হই, তাহলে যারা করে খাচ্ছেন তাঁরা কী? আর যারা মেরে খাচ্ছে তারা? এদের মধ্যে প্রথমোক্তরা অবশ্যই কর্মজীবী ও কর্মঠ।


আর শেষোক্তরা দারুণ বুদ্ধিমান এবং খুবই দক্ষ। তা তাঁরা অসৎ বা নীতিহীন এ রকম যত কথাই থাকুক না কেন।
আমি আমার দলের লোকদের বোঝাতে গিয়ে আরো অনেককে তাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। আসলে আমি আমার পেশার অর্থাৎ সাংবাদিকদের সম্পর্কে বলছিলাম। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে যখন ভাদ্র মাস শেষ হয়নি, তখন আমাদের ঢাকার এক দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, শরৎ এসে গেলেও গরম যায় নাই। মনে প্রশ্ন জাগল, ভাদ্র মাসে যদি শরৎকাল এসে যায়, তাহলে তালপাকা গরম পড়ে কবে? তখনই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাতে কিছু সাদা মেঘ আছে বটে, তবে সেগুলো মোটেই অমল-ধবল বা পেঁজা তুলোর মতো নয়। মেঘের ভেলার মতো ভেসেও বেড়াচ্ছে না, বরঞ্চ কেমন যেন গম্ভীর ও স্থির। আর কালো মেঘের ছোঁয়াও ছিল আকাশের এক কোণে। এর এক দিন পর দেখলাম আরেক ইংরেজি পত্রিকা অল্প কিছু সদ্য গজানো কাশফুলের একটা ছবি ছেপেছে। জানানো হলো শরৎ উপস্থিত।
তারও এক দিন পর সকালের দিকেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতেও হয়েছিল। তখন সরেজমিনে অনুভব করলাম তখনো কী রকম গনগনে রোদ হয়। সকাল ৯টার দিকে যখন প্রথম দফা হাঁটতে হলো, তখনই গায়ের চামড়ায় জ্বালা করছিল। খানিক পর মনে হলো মাথাও ভারী লাগছে। ভাবলাম, বেশ কয়দিন অনভ্যাসের ফল। অনভ্যাসের ফোঁটা চড়চড় করে, আর অনভ্যাসের রোদে গা চিড়চিড় করে। ভাগ্য ভালো, গন্তব্যের কাছাকাছি এসে হলেও একটা রিকশা ভাড়া পাওয়া গেল। এরপর ঘণ্টা তিনেক ঘরের ভেতর কাটিয়ে আবার যখন পথে নামলাম, তখন দেখি তাল পাকানো গরম। বরঞ্চ কাঠফাটা রোদ বলাই ভালো। ভেবেছিলাম যে একটা রিকশা পেয়ে যাব। তখন ধানমণ্ডির ভেতরের ওই রাস্তা থেকে সহজেই ঢাকা-মিরপুর রোডে পেঁৗছে একটা বেবিট্যাঙ্ ি(সিএনজি নামে বেশি পরিচিত) পেয়ে যাব। এ চিন্তা ভুল ছিল। একে তো সাইকেল রিকশার চলাচল সরকার পাড়া-মহল্লার ভেতরের রাস্তাগুলোতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার পর থেকে ঢাকায় রিকশা কমতে শুরু করেছে, তার ওপর অল্প যে কয়টা রিকশার দেখা পাওয়া যাচ্ছিল, সেগুলোর চালকদের অনেকেই প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে যাত্রী নিতেও সাহস পাচ্ছিলেন না। এখন মনে পড়ছে সেদিন দুপুরে ওখানে যে চার-পাঁচটা রিকশা দেখেছিলাম, তার চালকদের একজন ছিলেন খালি গায়ে। তাঁর বুক বেয়ে ঘাম ঝরছে আর পিঠে সূর্যের আলো চকচক করছে। তিনি রোদে গা পোড়াচ্ছিলেন এজন্য যে তাঁর জামাটা খুলে সেটা মাথায় বেঁধেছিলেন পাগড়ির মতো করে_যাতে রোদে মাথা ঘুরে না যায়। দৃশ্যটা দেখে ১৯৭৪ সালে নয়াদিলি্লতে থাকার কথা মনে পড়ে গেল। সেবার গ্রীষ্মের এক দুপুরে রাস্তায় কিছুটা হাঁটার সময় 'হিট স্ট্রোকের' মতো হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার পর শুরু হয় বমি। যতই পানি খাই না কেন, সবই উগরে আসে। বমির রং সবুজ। চোখেও যেন সবুজ, নীল আর হলুদ রং দেখছিলাম। আমার চোখে এর পরের চিত্র ছিল, আমি একটা হাসপাতালের বিছানায় এবং আমার হাতে ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইনের ব্যাগ লাগানো। ভারতে আমাদের প্রথম রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. এ আর মলি্লক আমার দুরবস্থার কথা জানতে পেরে আমাকে হাইকমিশনের চিকিৎসকের ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। না হলে সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া কঠিন হতো। ওই চিকিৎসক পরে আমাকে বলেছিলেন, 'আমার শাস্ত্রীয় বিদ্যার সবটাই ব্যবহার করেছি আপনাকে সুস্থ করতে।' তাই কোনো রিকশাচালক যদি প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ছায়ার আশ্রয় ত্যাগ করতে রাজি না হন, তাতে মনোক্ষুণ্ন হই না। বুঝলাম, গায়ের জামা খুলে মাথায় বেঁধে রিকশা চালিয়ে ওই চালক তাপদাহ ও ক্ষুধা দুটোর হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলেন।
আমিও অবশেষে একটা রিকশা পেয়েছিলাম, তবে ধানমণ্ডির এক সড়ক থেকে পাশের সড়কে যেতে ভাড়া দিতে হয়েছিল কুড়ি টাকা। তখন ভেবেছিলাম মাশুলটা বেশিই হয়ে গেল। আরো ভেবেছিলাম রিকশাচালকদের আয় বেড়েছে। মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন তিন বেলা ভাত খায়, কেউ কেউ চার বেলা খায়। আমি ভাবলাম তাঁর কথাটা সঠিক। কিন্তু অবস্থা একটু অন্য রকম। মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় ঢাকার রিকশাচালকদের প্রকৃত আয় বাড়েনি। নির্দিষ্ট অলিগলির মধ্যে তাদের চলাচল সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বরঞ্চ যাত্রী কমেছে। তাই ভাড়া বাড়িয়ে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। তারপরও যা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য দুবেলা ভাত জোটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। চার বেলা ভাত খাওয়ার চিন্তা করা কল্পনার ফানুস উড়ানো তাঁদের জন্য। অপুষ্টি আক্রান্ত দেহ আর মলিন মুখ দেখেও আঁচ করা যায় যে সুখে নেই তাঁরা।
আমাদের অর্থনীতি খুব ভালো চলছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটো বিশেষ বৈঠক করার পর এরকম প্রচার করা হয়েছিল। এর একটা বৈঠক হয়েছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত দপ্তরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে, আর অন্যটি সচিবদের সাথে। বাস্তবের সঙ্গে এসব দাবির যদি বেশ মিল থাকত, তাহলে খুবই খুশি হতাম। কারণ, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ হিসেবে মূল্যস্ফীতির ধারা সামলাতে গিয়ে যে হাঁফিয়ে উঠেছি, তা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করি। 'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু' গেয়ে প্রার্থনা করলে ঈশ্বর হয়তোবা মাফ করে দেবেন কিন্তু অসীম ঊর্ধ্বমুখী বাজারদর তো ক্ষমা করছে না। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ক্লান্তি যতই চেপে ধরুক না কেন, কাজ করে যেতেই হবে, যেভাবে পারা যায় দুটো পয়সা আয় করতেই হবে। এও ঠিক যে জীবনের ঝুঁকিও বেড়েছে, কিন্তু সম্ভবত তার চেয়ে বেশি বেড়েছে ইজ্জত যাওয়ার ঝুঁকি। তাই ঝুঁকি নিয়েই কাজকর্মে যেতে হয়, হাটবাজার করতে হয়। বিশেষ করে নারীদের বেলায়। সরকারের ফুরফুরে মেজাজটাও এখন আর নেই। তাই সরকারি লোকদের মন খারাপ হয়, এমন ধরনের কথা বলতে ভয় করে। তথ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিতে বিবেচনার জন্য সরকার বেসরকরি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের (রেডিও-টিভি) জন্য নীতিমালার যে খসড়া পাঠিয়েছে, তাতে যেমন হুমকি আর ধমক দেওয়া হয়েছে, তারপর কথা বলতে ভয়ই করে। কিন্তু আইএমএফ এবং বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ব্যুরো মূল্যস্ফীতি ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ যে তথ্য দিয়েছে, তা দেখে আমাদের চেপে রাখা দুশ্চিন্তা ও ভীতির কথা বলে ফেলতে একটু সাহস পেলাম।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের প্রধান ডেভিড কোয়েন বলেছেন, সরকারের দুর্বল আর্থিক নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। তিনি এও বলেছেন যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং তার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে এবং এই মূল্যস্ফীতি আরো হতে পারে। এদিকে বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের ওপর চাপ বাড়বে। এখানে আমরা যোগ করতে পারি যে সরকার এখন ব্যাংক ঋণের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম দেড় মাসেই সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অবশেষে অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন যে পরিস্থিতি একটু কঠিন। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, গত আগস্ট মাসে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে এক বছর আগের তুলনায় ১১.২৯ শতাংশ এবং খাদ্যমূল্য বেড়েছে ১২.৭০ শতাংশ। আমরা শুনতে পাই, এই হারে মূল্যবৃদ্ধি বিপজ্জনক। তবে আমাদের পরিচিতরা বলছেন, এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতির হার আরো বেশি। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে লাগামহীনভাবে। চাল-তেল-পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। সঙ্গে বাড়ছে সবজি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের দাম। এই মূল্যস্ফীতি ঘটছে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবেই। একই মাসে এবং একইরকমভাবে ঢাকায় বেড়েছে বাড়িভাড়া এবং সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে চিকিৎসা ব্যয়, বিশেষ করে ওষুধের দাম। আর আমরা এমন কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না যে এর সবটাই বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফল। আমরা যদি বলি যে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হারের একটি কারণ ব্যাপক দুর্নীতি_তাহলে সেটা যে ভুল দাবি, এমন কথা বলবেন কম লোকই।
দেশের অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই। বাড়তি ভয় হলো, অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টাইন লাগার্ড বলেছেন, 'এই দেশগুলো সংকটের নতুন পর্যায়ে ঢুকতে চলেছে।' আইনমন্ত্রকের নির্বাহী প্রধান এও বলেছেন যে, 'যদিও বৈশ্বিক হিসাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু তার ধারা মন্থর। তদুপরি দেশে দেশে বেকারত্বের হার যা দাঁড়াচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।'
ইউরোপে তো টালমাটাল চলছেই, এখন ইউরো মুদ্রার এলাকাতেও যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভয়াবহ মন্দা দেখা দেয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। এ সময় দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুবই দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা তা হতে দেবে কি?
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। তবে যা কলমের মুখে এসে গেল, তা তো রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে শীর্ণ রিকশাচালকের প্রসঙ্গ ওঠায়। তো সেদিনের পর থেকেই আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করে। গতকাল এই লেখার সময়ও মেঘ ও বৃষ্টি দুই-ই ছিল। কাশফুল সময়মতো ফোটা শুরু করলেও শরতের আকাশ গতকালও দেখা যায়নি। তবুও সবাইকে আশু শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.