শিক্ষা দিবস-জীবনের জন্য শিক্ষা by বনরূপা

জ থেকে ৫১ বছর আগে, ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষানীতি বাতিল করে 'সবার জন্য শিক্ষা' ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ছাত্রসমাজের এ আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল পুরোপুরি। মূলত ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান তৎকালীন শিক্ষাসচিব এস এম শরীফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যের জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের কারণে ছাত্রসমাজ ও জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ও আন্দোলন প্রসারিত হতে থাকে।


এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ১৭ সেপ্টেম্বরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন আইয়ুব খান সরকারকে বাধ্য করে শিক্ষানীতি স্থগিত করতে। ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন দমন করার জন্য গ্রেপ্তার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন, বেত্রদণ্ডসহ বর্বরোচিত নানা শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রসমাজ ও জনগণের আন্দোলন এবং হরতাল কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য নানা ধরনের নির্যাতনমূলক পথ গ্রহণ করা হয়। ওই দিন ঢাকাসহ সারা দেশের পথে পথে বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ মিছিল আবদুল গনি রোড হয়ে অগ্রসর হলে মিছিলের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করা হয়। ওই দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন এবং সারা দেশে অনেক ছাত্র-জনতা পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে ও নির্যাতনে আহত হয়। ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলন আরো বেগবান করে তোলে। এ সবই ইতিহাসের অংশ। সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসাধারণ সমর্থিত ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুবের সামরিক সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি স্থগিত করতে বাধ্য হয়। গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এবং গণমুখী শিক্ষানীতির দাবিতে ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র আন্দোলন এবং ওই আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান ও শিক্ষার ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্রতিবছর এই দিনটি ছাত্রসমাজ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে। আজও শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালনের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আজও পুরোপুরি সফল হয়নি। যে মহান লক্ষ্য নিয়ে তৎকালীন ছাত্রসমাজ শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিল, শহীদ হয়েছিলেন অনেকেই, সেই লক্ষ্য অর্জনে আজও আমরা সফল হতে পারিনি। স্বাধীনতার চার দশক পরও আজ আমাদের নাগরিকদের প্রায় অর্ধেক নিরক্ষর। দেশের সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রায় ৪৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সমাজে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্র ক্রমবিবর্ণ হচ্ছে। ফলে ২০১৫ সালের মধ্যে সব শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনেকটা অনিশ্চিত। বাস্তবসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করার জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে, তা এক অন্তহীন প্রশ্ন। 'জীবনের জন্য শিক্ষা'_এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে পারলে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাহলেই আমাদের ছাত্রসমাজের ও শহীদদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। শিক্ষা একটি জাতির উন্নতি-অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রের। শিক্ষা ভিন্ন সমাজ-রাষ্ট্র আলোকিত হতে পারে না।
বনরূপা

No comments

Powered by Blogger.