ইমান ও স্বাধীনতা by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

জ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে এদিনে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্বের মানচিত্রে সগর্বে জায়গা করে নেয় মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে যারা জানমাল বাজি রেখে স্বদেশের জন্য, মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তাদের এ নৈতিক অধিকারকে ইসলাম সমর্থন করে সর্বতোভাবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব। তিনি মদিনাকে স্বাধীন করেছিলেন মুনাফিক চক্র


এবং সুদখোর, চক্রান্তবাজ, ইহুদিদের কবল থেকে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যে কতটা স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তার পরিচয় মেলে পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধে। মদিনার ইহুদিদের প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশরা যখন মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়, তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে সাহাবি হজরত সালমান ফারসির (রা.) পরামর্শক্রমে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করেন। মুসলমানরা যাতে এ কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজেও পরিখা খননের কাজে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী পরিখা পার হয়ে মদিনায় আসতে না পেরে কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর ব্যর্থ মনে মক্কায় ফিরে যায়। সে সময় এটা ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী বিজয় ধরে রাখতে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ।
অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কাকে মুক্ত করলেন জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার কবল থেকে। অতঃপর সামান্য সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধিকে বিস্তৃত করে পুরো আরব ভূখণ্ডকে ভরে দিয়েছিলেন অবারিত শান্তি ও নিরাপত্তায়, অভূতপূর্ব শৃঙ্খলায়, অপূর্ব সুষম বণ্টনে, অবর্ণনীয় ভ্রাতৃত্ববোধে এবং স্বপ্নাতীত কল্যাণে।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করে আমরাও বহু রক্ত, জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে শত শত বছরের অধীনতা আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতা। কিন্তু এ স্বাধীনতা আলো ছড়াতে পেরেছে কি? এত রক্ত, এত প্রাণ ও ত্যাগ স্বীকার করে বিজয় অর্জনের উদ্দেশ্যই-বা কী ছিল? তখন প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা ছিল, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সবাই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ লাভ করবে। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী, শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত জনপদ গড়ে উঠবে, যেখানে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জাতীয় অর্জনের সুফল ভোগ করবে। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর ৪১ বছরে দেশবাসীর স্বপ্ন আর প্রত্যাশার রূপায়ণ সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কেন? আমাদের কিসের অভাব? ঘাটতি শুধু এক জায়গাতেই। তা হলো দেশপ্রেম।
অথচ মানবতার ধর্ম ইসলামে দেশকে ভালোবাসার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামের কথা হলো দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবনাদর্শ ও স্বভাব-চরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি নিজের মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, 'হে আমার স্বদেশ! আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।'
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের বিষয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ শিক্ষাই আমাদের শিখিয়েছেন। অষ্টম হিজরিতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বিজয়ী বেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তার স্বগোত্রীয় লোকেরা হারাম শরিফে অপরাধী হিসেবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। এমন মুহূর্তে স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা দেশের সীমানা রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে তাদের সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'একদিন ও একরাতের সীমান্ত পাহারা ধারাবাহিকভাবে এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারারাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম।' _মুসলিম
প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেম মহত্ত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মহান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে স্বদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার শিক্ষা দেয়। অতএব, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও এই বিজয়কে অর্থবহ করতে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশকে কিছু দেওয়ার মনমানসিকতা তৈরি করা, দেশকে ভালোবাসতে শিখা। তাহলেই সুখী সমৃদ্ধিশালী, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.