নিখোঁজ অতঃপর লাশ by সাহাদাত হোসেন পরশ

কারও সন্তান-স্বামী বা কোনো স্বজন বাসা থেকে বের হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে না ফিরলেই স্বজনের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে 'গুম আতঙ্ক'। রাজধানীসহ সারাদেশে জনমনে এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি একের পর এক রহস্যজনক নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। নিখোঁজদের কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও দীর্ঘদিনেও খোঁজ মিলছে না অনেকের। হতভাগ্য অনেক পরিবারের স্বজনের অভিযোগ, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন।
তাদের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ধরনের অপহরণ ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করছে।
অনেকের অভিযোগ, রাজনৈতিক বিরোধ ও অর্থনৈতিক লেনদেনের কারণে অপহরণ ও গুমের ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে এসবের নেপথ্যে ব্যক্তিগত বিরোধও কাজ করছে। গুপ্তহত্যা বন্ধে মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অনেকে বলছেন, 'গুপ্তহত্যা' ক্রসফায়ারের চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগীদের স্বজনরাও বলছেন, ক্রসফায়ারের পর অন্তত লাশটি পাওয়া যায়। গুপ্তহত্যার পর অনেক ক্ষেত্রে লাশও মিলছে না।
সুস্থ-সবল মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ মিলছে কোনো সড়ক বা মহাসড়কের পাশে কিংবা কোনো জলাশয়ে বা নদীতে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কোনো লাভ হচ্ছে না। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ সালনায় ইউটা পোশাক কারখানার সামনে থেকে যশোর জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকালই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে আরও এক বিএনপি নেতার গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। এদিকে গত আট দিনে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে পাঁচ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজি নূর মোহাম্মদ ওরফে
নুরু হাজির মেয়ের জামাই আবদুল মান্নান ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকবাল হোসেন গত ৩ ডিসেম্বর থেকে 'রহস্যজনক নিখোঁজ'। পরিবারের সদস্যদের আশঙ্কা, তারাও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এর আগে ১৯ অক্টোবর রাতে সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুরের বাসা থেকে কালো পোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায় নুরু হাজিকে। শ্বশুরের নিখোঁজ হওয়ার ৪৫ দিন পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ মেয়ের জামাই নিখোঁজ হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা ভর করেছে।
এ বিষয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান সমকালকে বলেন, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়ার পর যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে মাঠে নেমেছে র‌্যাবের একাধিক টিম। শিগগিরই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত দু'একটি গ্যাংকে গ্রেফতার করে আসল রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। অপরহণ-গুমের সঙ্গে র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করেন মোখলেছুর রহমান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আজিজুল হক সমকালকে বলেন, পত্রিকায় এসব খবর দেখে আমরাও উদ্বিগ্ন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রত্যেকটি ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত বিষয় বের করে আনা দরকার। তা না হলে এসব ঘটনা খুব বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করবে। সমাজের সব ক্ষেত্রেই এটার প্রভাব পড়বে। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য আসলেই এতে জড়িত কি-না তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। দাফতরিক কার্যক্রমের বাইরে কেউ এ রকম ঘটনায় জড়াচ্ছে কি-না সেটা নজরদারিতে রাখতে হবে। আবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ব্যবহার করে পেশাদার সন্ত্রাসীরাও এ রকম ঘটনা ঘটাতে পারে। সরকারকে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা যখন খারাপের চরম পর্যায়ে পেঁৗছায়, কেবল তখনই এমন ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। অপরাধীরা তখন নিজেদের নিরাপদ মনে করে। তারা ধরে নেয়, এমন হত্যাকাণ্ড ঘটালেও তাদের কেউ কিছুই করতে পারবে না। অপরাধীদের এমন ধারণা থেকেই এসব বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগীদের স্বজনের অভিযোগ, সাদা পোশাকের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর থেকেই তারা নিখোঁজ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু অবাক কাণ্ড_ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী 'আমাদের লোক ধরেনি' এমন একটি বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। কিন্তু তাহলে দেশের এসব নাগরিককে কারা নিয়ে হত্যা ও গুম করছে, তা উদ্ঘাটন করার দায়িত্ব কি আমাদের না সরকারের?
বিবিসি জানায়, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে অপহরণ এবং গুপ্তহত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গুপ্তহত্যার পেছনে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিরোধী দল এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপির যশোর জেলার এক নেতা নাজমুল ইসলামসহ ৪ ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। র‌্যাব বলছে, গত ৯ দিনে মোট ৮টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং নিহতদের পরিবারের অনেকের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অভিযোগ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সে প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান অপহরণের পর হত্যাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন কৌশল বলে মনে করছেন। এসব ঘটনায় কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থাকতে পারে? এ ব্যাপারে তিনি বলেন, নিহতদের পরিবারের সদস্যরা যখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তখন তারা অভিযোগ করছেন ওই বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে নিয়ে গেছে। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ওই বাহিনীর গাড়িতে বা সাদা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
গত ২৮ নভেম্বর ছাত্রদলের আরও দু'জন নেতা অপহরণের বিষয়ে অভিযোগ ওঠে। এর কয়েকদিন পরে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। এদিকে অধিকার বলছে, এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত অপহরণের পর মোট ২২টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অধিকার বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১৮টি। বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অপরাধী চক্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।
র‌্যাবের ডিজির বক্তব্য : র‌্যাব মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেছেন, সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়ার পর যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে মাঠে নেমেছে র‌্যাবের একাধিক টিম। শিগগিরই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত দু'একটি গ্যাংকে গ্রেফতার করে আসল রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, অপহরণ-গুম নতুন কিছু নয়। ১৮৬০ সালে পেনাল কোডেও অপরাধ হিসেবে অপহরণ-গুমের কথা উল্লেখ আছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণ ও গুমের ঘটনা অনেক কম বলে দাবি করেন র‌্যাব মহাপরিচালক। অপহরণ-গুমের সঙ্গে র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করেন মোখলেছুর রহমান।
সমকালের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, অপহরণ-গুমের সঙ্গে র‌্যাবের কোনো সদস্যের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। বরং র‌্যাব বিভিন্ন সময় অপহরণ ও গুমের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু চক্রকে গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব গঠনের পর অপহৃত ৯৭৬ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত ৭শ' ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।
মোখলেছুর রহমান বলেন, পুলিশ-র‌্যাব-ডিবি পরিচয়ে যারা অপহরণ করছে, তাদের গ্রেফতার করতে আমরা কাজ করছি। যারা অপহরণ হচ্ছে, তারা কেউ নিজেরাই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। কেউ সর্বহারা দলের সদস্য। কেউ কেউ সামাজিক-পারিবারিক বিরোধ ও নিজ দলের কোন্দলের শিকার হচ্ছেন।
র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল সমকালকে জানান, ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে র‌্যাব। কারা ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত_ এটা উদ্ঘাটনে র‌্যাবের একাধিক বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে।
কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, এ বছর অপহরণ, অপহরণের পর মুক্তি ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৬৪০টি। গত বছর এ ধরনের ঘটনা ছিল এক হাজারের ওপর। ২০০২ সালে এমন ঘটনা ছিল দেড় হাজারের বেশি। একটি গ্রুপ অনাকাঙ্ক্ষিত আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার পর গুম বলে চালানোর চেষ্টা করছে। মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবলকে ক্ষুণ্ন করতে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে।
ডিসিডিবির বক্তব্য : ডিএমপি কমিশনারের মুখপাত্র ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, যে কোনো সময় অপহরণ ও নিখোঁজের জিডি এবং মামলা হলে আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করি। সম্প্রতি যেসব অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কোনো পেশাদার কিলার এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
বিএনপি নেতা নাজমুল ইসলামের লাশ উদ্ধারের বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, কোনো দুষ্কৃতকারী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। ঝিকরগাছা চরমপন্থি এলাকা। এ ঘটনার পেছনে চরমপন্থি কোনো গ্রুপ জড়িত কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি মামুনুর রশীদ খোকা জানান, মুন্সীগঞ্জ শহর লাগোয়া ধলেশ্বরী নদীতে অজ্ঞাত পরিচয় ৩ লাশের মধ্যে একজনের লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে, অপর শনাক্ত হওয়া লাশ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
ধলেশ্বরী নদী থেকে গত ৮ দিনে ৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ এসব ঘটনার কোনো ক্লু-উদ্ঘাটন করতে পারেনি। হত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের চিহ্নিত করতে পুলিশ এখন পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, মুন্সীগঞ্জের নৌপথ অরক্ষিত হয়ে পড়ায় ধলেশ্বরীতে একের পর এক লাশ উদ্ধার হচ্ছে। অপরাধীদের কাছে ধলেশ্বরী যেন লাশের 'ডাম্পিং জোন'।
মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এহসানুল করীম জানান, মর্গ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে কাঁচামাল ব্যবসায়ী মঞ্জু মুন্সীর লাশ বুঝে নেন নিহতের স্ত্রী রানী বেগম। পরে নিহতের দু'ছেলে মোশারফ, মিজান ও স্ত্রী রানী বেগমসহ অন্য স্বজনরা বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে নিহতের লাশ নিয়ে ফরিদপুরের সালতা উপজেলার লক্ষ্মণদিয়া গ্রামের বাড়িতে পেঁৗছেন। নিহত মঞ্জু মুন্সীর বাবা রশীদ মুন্সী। মঞ্জু মুন্সী কাঁচামালের ব্যবসা করতেন সিদ্ধিরগঞ্জের শানারপাড় বাজারে। তাছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ীতেও তার কাঁচামালের আড়ত ছিল। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মঞ্জু মুন্সীর মৃত্যুতে পুরো পরিবারে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তার অন্ধকার।
লাশের খোঁজে স্বজনরা : দেশের কোথাও থেকে কেউ নিখোঁজ হলেই লাশের সন্ধানে স্বজনরা ছুটে আসছেন ধলেশ্বরীর পাড়ে। ইতিমধ্যে সবারই ধারণা হয়ে গেছে, কেউ গুম হলে সেই লাশ মিলতে পারে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরীর বুকে। এতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে গত ২-৩ দিনে অসংখ্য মানুষ এসেছেন মুন্সীগঞ্জ শহরে। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গ, ধলেশ্বরীর পাড় ও সদর থানা ভুক্তভোগীদের গন্তব্য। স্বজনের খোঁজে তাদের অনেকে মুন্সীগঞ্জে রাত কাটাচ্ছেন। বুধবার বিকেলে ফরিদপুরের সালতা উপজেলার লক্ষ্মণদিয়া, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন নিখোঁজদের খোঁজে আসেন জেলা শহরে। ওই রাতটি আবাসিক হোটেলে কাটিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আবারও তারা ছুটেছেন স্বজনের খোঁজে।
৩টি লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে বুধবার সকালে মুন্সীগঞ্জের মর্গে স্বজনের খোঁজে আসেন মনিকা নামের এক তরুণী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ছাত্রদলের সাহিত্য সম্পাদক শামীম হাসান সোহেলের বাগদত্তা স্ত্রী। গত ২৮ নভেম্বর শামীম হাসান সোহেল ঢাকার হাতিরপুল এলাকার মোতালেব প্লাজার সামনে থেকে কথিত র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছিলেন বলে মনিকার দাবি। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার খেপুপাড়া উপজেলার পাঁচজুনিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুস সাত্তার চৌধুরী। মর্গে পড়ে থাকা লাশ দেখার পর স্বামীর লাশ না পেয়ে বিকেলে তিনি ঢাকা চলে যান। ঢাকার হাতিরপুলের ঘটনায় অপর নিখোঁজ মাসুমের স্ত্রী হাওয়া বেগম টাকার অভাবে স্বামীর খোঁজে আসতে পারছেন না বলে জানান শামীম হাসান সোহেলের স্ত্রী মনিকা।
মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর নৌ-ফাঁড়ি দায় এড়াবে কীভাবে!
ধলেশ্বরী নদী তীরবর্তী এক বাসিন্দা জানান, ধলেশ্বরী নদীর শাহ সিমেন্ট এলাকা ও শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী মোহনা রাতে বেশ নিরিবিলি হয়ে পড়ে। রাত ৮টার পর পুলিশের টহলও থাকে না। দূরপাল্লার লঞ্চ চলাচল ছাড়া স্থানীয় ট্রলার, ভলগেট বা অন্যান্য নৌযান চলাচল রাতের বেলায় অনেকটা কম থাকে। গত ৮ ডিসেম্বর শহরের কাছে মোল্লারচর এলাকায় ধলেশ্বরীতে অজ্ঞাত পরিচয়ধারী ২টি লাশ, ১৩ ডিসেম্বর শহরের কাছে নয়াগাঁও, হাটলক্ষ্মীগঞ্জ লঞ্চঘাট এলাকায় এক কিলোমিটারের মধ্যে ৩টি লাশ এবং গত ২৪ অক্টোবর ভোরে ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা মোহনার কাছে বালুমহালের কালেক্টর জামাল হোসেনের লাশ, গত ১৫ অক্টোবর শহরের উপকণ্ঠ কাঠপট্টি এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয় আরও এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে নৌ-ফাঁড়ি পুলিশ। উদ্ধার করা লাশের ধরন থেকে জানা গেছে, সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে লাশগুলো নদীতে ফেলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মুক্তারপুর নৌ-ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিজানুর রহমান বলেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পুলিশের পৃথক পৃথক টিম ধলেশ্বরীতে টহল দেয়। দক্ষতার সঙ্গে নৌপথে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। কাজেই ধলেশ্বরী নদীর কোথাও ঘাতকরা লাশ ফেললে তা পুলিশের নজরে আসত।
কিশোরগঞ্জ (করিমগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জে থেকে এক মাস আগে অপহৃত হওয়া শফিকুল ইসলাম ও জসীম উদ্দিন নামের দুই ব্যবসায়ী বন্ধুর সন্ধান এখনও পায়নি তাদের স্বজনরা। গত মাসে তারা করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। দীর্ঘ এক মাসে তাদের সন্ধান না পাওয়ায় অপহরণ ও গুম আতঙ্কে ভুগছেন এলাকাবাসী।
নিখোঁজ হওয়া ব্যবসায়ীর মামা ফারুক মিয়া জানান, তার ভাগ্নে শফিকুল ইসলাম একজন ঝুট ব্যবসায়ী। শফিক ও জসীম তার বন্ধু একই ব্যবসা করতেন। গত ১৪ নভেম্বর তারা গাজীপুরের ব্যবসায়ী স্বপনের কাছ থেকে মালপত্র কিনতে যান। ওই দিন ব্যবসায়ী স্বপন অপহৃত হয়। তার একদিন পর থেকে ব্যবসায়ী জসীম ও শফিককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মীর রেজাউল আলম বলেন, পুলিশ প্রশাসনের কাছে শফিক ও জসীম অপহরণের কোনো তথ্য নেই। তাদের অপহরণের ব্যাপারে থানায় লিখিতভাবে পুলিশকে অবহিত করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.