জনসমক্ষে একমাত্র আত্মসমর্পণ

বিশ্বে সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণের ঘটনা কেবল একটিই, যা ঘটেছে আমাদের প্রিয় ঢাকায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে ফুটে উঠেছে চার দশক আগের সেই শীতের পড়ন্ত বিকেলের চিত্র। এক পক্ষ তখন মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত, অন্য পক্ষের সামনে কেবলই আঁধার তখন অন্ধকার নেমে আসে ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।


আলো কমে আসছে। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে একটি টেবিলে বসে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করলেন লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। হাজার হাজার বাঙালি জয় বাংলা ধ্বনি দিচ্ছে। কিন্তু তারা যাতে কাছে পেঁৗছাতে না পারে সে জন্য ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি অফিসারদের ঘিরে রেখেছে। মিত্র বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা এক সৈন্যের কাঁধ থেকে আরেকজনের কাঁধে ঘুরছেন। অন্ধকার নেমে এসেছে।
এর আগে ভারতীয় পারাট্রুপাররা ঢাকায় প্রবেশ করার সময় হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বাগত জানায়। ভারতীয় সেনাদের বহন করা বাসের ছাদে উঠে আনন্দে নৃত্য করতে থাকে উল্লসিত জনতা। জনগণ তৃষ্ণার্ত ভারতীয় সেনাদের বাসা থেকে এনে পানি খেতে দেয়।
লে. কর্নেল বি পি রিখে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, দলিল সইয়ের সময় দু'পক্ষের ইউনিটগুলোকে কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। এরপর অরোরা প্রথা অনুযায়ী নিয়াজির কাঁধ থেকে সৈনিকের ব্যাজ খুলে নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র নামিয়ে রাখে। অরোরাকে জনতা কাঁধে তুলে নেয়। জনতা ছুড়ে দেয় ফুল।
স দি টাইমস, লন্ডন, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বন্দুকের নলে ফুল
ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ :চারদিকে জয় বাংলা ধ্বনি। আন্দোলিত বাংলাদেশের পতাকা। ট্রাকে ও বাসে চেপে ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে প্রবেশ করছে। তাদের বন্দুকের নলে বাঙালিদের দেওয়া গাঁদা ফুল। পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা ভারতীয় সেনা অফিসারদের স্যালুট দিচ্ছে। উভয় পক্ষের অফিসাররা এক সময়ে পড়েছেন একই ব্রিটিশ সামরিক স্কুলে। তারা হাত মেলাচ্ছেন এবং পরস্পরের ও পুরনো বন্ধুদের কুশল জানতে চাইছেন।
ঢাকায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ। সর্বত্র উৎসব চলছে। তারা ভারতীয় সৈন্যদের জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাচ্ছেন। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা যাচ্ছে গাড়িতে। জয় বাংলা ও শেখ মুজিব স্লোগান সবার মুখে।
একজন মুক্তিসেনা ক্ষুব্ধ বাঙালিদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন, যাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহযোগী দালালদের ওপর হামলা করা না হয়।
বিকেলে দু'পক্ষের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আলোচনায় আত্মসমর্পণের আয়োজন নিয়ে কথা হয়। জেনারেল ক্লার বলেন, পাকিস্তানিরা ভালোই লড়েছে। তবে শেষ অবস্থান ধরে রাখার জন্য শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত লড়ে যায়নি। এটা ভালো হয়েছে।
স নিউইয়র্ক টাইমস, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানও তুলে দিলেন
লে. জেনারেল নিয়াজি মেজর জেনারেল জামসেদকে পাঠান মেজর জেনারেল নাগরাকে স্বাগত জানানোর জন্য। মাত্র কয়েকজন সৈন্য সঙ্গে করে বিপুল গর্বভরে তিনি ঢাকায় প্রবেশ করেন। দুপুরের কিছু পর ব্রিগেডিয়ার বকর বিমানবন্দরে যান মেজর জেনারেল জ্যাকবকে স্বাগত জানাতে। ইতিমধ্যে নিয়াজি নাগরাকে একের পর এক কৌতুক শোনাতে থাকেন। এগুলো ছাপার যোগ্য নয়। জ্যাকব একটি আত্মসমর্পণের দলিল সঙ্গে নিয়ে আসেন, যাকে জেনারেল নিয়াজি এবং তার স্টাফপ্রধান 'খসড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি' বলতে চান। জ্যাকব তার কাগজ বকরের হাতে এগিয়ে দেন এবং তিনি তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির দিকে বাড়িয়ে দেন। ফরমান আলি 'ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড' বাক্যে আপত্তি করেন। জ্যাকব বলেন, এভাবেই দিলি্ল থেকে এসেছে এবং বদলানো যাবে না। নিয়াজির হাতে দলিলটি তুলে দেওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য না করে ফরমান আলির দিকে বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, এটা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের দায়িত্ব কমান্ডারের। নিয়াজি নিশ্চুপ থাকেন এবং এটাকেই তার সম্মতি বলে ধরে নেওয়া হয়। বিকেলে তিনি বিমানবন্দরে যান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে স্বাগত জানাতে। উল্লেখযোগ সংখ্যক বাঙালি অরোরা এবং তার স্ত্রীকে স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন। নিয়াজি তাকে স্যালুট করেন। বিজয়ী ও বিজেতার সামনে বাঙালিরা, যাদের জন্য অরোরার প্রতি ছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং নিয়াজির প্রতি ঘৃণা। স্লোগানের মধ্যেই দু'জনে অন্যদের নিয়ে এগিয়ে যান রেসকোর্স ময়দানের দিকে। আবেগাপ্লুত অনেক বাঙালি সেখানে সমবেত হয়েছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রকাশ্যে অবমানিত হওয়া দেখতে এসেছে। এ অনুষ্ঠান বাংলাদেশের অভ্যুদয় আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়ারও। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ইউনিট বিজয়ীদের গার্ড অব অনার প্রদান করে। আত্মসমর্পণের দলিলে সই হলে জেনারেল নিয়াজি তার রিভলবার অরোরার হাতে তুলে দেন। এটা আত্মসমর্পণের প্রতীক। এর সঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকেও তুলে দেন!
স পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালেকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থ থেকে

No comments

Powered by Blogger.