সাবি্বর হত্যা মামলার পাঁচ আসামি খালাস

হুল আলোচিত বসুন্ধরা গ্রুপের আইটি বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন কবির সাবি্বর হত্যা মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে প্রধান আসামি সানবীরসহ পাঁচজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত ও উপযুক্ত দুই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আদালতে হাজির করতে 'ব্যর্থ হওয়ায়' মামলার সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের


বিচারক মোঃ মোতাহার হোসেন জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন_ সামসুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল হাসান ওরফে উজ্জ্বল, নূরে আলম ও হুমায়ুন কবীর। এর মধ্যে সামসুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল হাসান ওরফে উজ্জ্বল আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর তাদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা তাদের আইনজীবীদের রিকল করার আবেদন আদালত মঞ্জুর করেন। এর ফলে সানবীরের দেশে ফিরতে আর কোনো বাধা রইল না।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩৫ সাক্ষীর মধ্যে দুই যৌনকর্মী পাপিয়া গাইন ও সাদিয়া আখতার রাত্রিকে হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়। অথচ মামলাটির বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করলেও মামলার প্রত্যক্ষদর্শী এ দুই সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ হিসেবে আদালত উল্লেখ করেন, যেহেতু ওই দুই যৌনকর্মী ভ্রাম্যমাণ বা ভাসমান, তাই তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই অথবা তারা লোকলজ্জার ভয়ে আদালতে উপস্থিত হননি। যদিও এ দুই সাক্ষী মামলার বিচার শুরু হওয়ার আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী ঘটনার
প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিশদ বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। বিচারক রায় ঘোষণার সময় প্রকাশ্য আদালতে এ দুই যৌনকর্মীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দি যদি ভিডিও করা যেত, সেটা যদি দালিলিক প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যেত তাহলে মামলাটির পরিণতি অন্যরকম হতে পারত। আইনি দুর্বলতার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। তাই রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে মামলাটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আসামিদের বেকসুর খালাস দেওয়া হলো।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, এ দুই যৌনকর্মীকে আদালতে হাজির করার জন্য ১২ বার বিভিন্নভাবে সমন, ওয়ারেন্ট দেওয়া হলেও তারা আদালতে হাজির হননি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো গাফিলতি নেই।
ঢাকার আদালতের ফৌজদারি আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন বলেন, রাত্রি ও পাপিয়া আদালতে এসে সাক্ষ্য না দিলেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাদের দেওয়া জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্যের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা হলে আইনগত কোনো বাধা ছিল না। সে ক্ষেত্রে দুই যৌনকর্মীকে মামলার গুরুত্ব বুঝে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ওই জবানবন্দি প্রদানের পরপরই নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া উচিত ছিল।
আদালতে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট টিএম আকবর, অ্যাডভোকেট মাহবুব আহম্মেদ ও অ্যাডভোকেট এএফএম আবদুল ওয়াদুদ। সানভীর পলাতক থাকায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তার পক্ষে অ্যাডভোকেট গাজী শাহ আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। গতকাল আদালতে রায় ঘোষণার সময় বাদীপক্ষের কোনো আইনজীবী বা আত্মীয়স্বজনকে দেখা যায়নি। আসামি পক্ষ থেকে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
২০০৬ সালের ৪ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে বসুন্ধরা টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক লিমিটেডের পরিচালক হুমায়ুন কবির সাবি্বর খুন হন। ২০০৮ সালের ১২ মে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত (সিআইডি) বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আরমান আলী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সাফায়াত সোবহান সানবীরকে মামলার প্রধান আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। এতে ৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়। গত বছর ৭ মার্চ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসে।
তদন্তে জানা যায়, ঘটনার দিন রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি গেস্ট হাউস থেকে দুই যৌনকর্মী পাপিয়া ও রাত্রিকে বিনোদনের জন্য ভাড়া করে আনেন নিহত সাবি্বর, পলাতক সানভীরসহ অন্যরা। এক পর্যায়ে সানভীর ও সাবি্বরের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলে সানভীরের হাতে থাকা মদের বোতল দিয়ে সাবি্বরের মাথায় আঘাত করলে সাবি্বর মারা যান বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়। তারপরই তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ২১ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে মামলার দায় থেকে সানভীরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
এ ঘটনায় সাবি্বরের ভগি্নপতি এএফএম আসিফ বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলাটি করেছিলেন। সাবি্বর খুন হওয়ার পর সানবীর দেশ ছেড়ে চলে যান। সে সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাকে দেশ ত্যাগে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেফতার হওয়ার পর বাবর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তিনি সানবীরকে খুনের মামলা থেকে বাঁচাতে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছ থেকে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় শাহ আলম, তার দুই ছেলে সাফায়াত সোবহান সানভীর ও সাহাদাত সোবহান, সাবেক সাংসদ বিএনপি নেতা কাজী সালিমুল হক কামাল, ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের পরিচালক আবু সুফিয়ান এবং তারেক রহমানের এপিএস মিয়া নুরউদ্দিন অপুও আসামি। আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৫ ও ১৬৫(ক) ধারায় বিচার শুরুর পর ২০০৮ সালের আগস্টে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। শাহ আলম ও তার দুই ছেলের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হয়। কিন্তু তারেক রহমান, বাবর ও আবু সুফিয়ানের আবেদনে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। এ অবস্থায় পুরো মামলার বিচারকাজ বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.