শীতবস্ত্রের অভাবে কাহিল ছিন্নমূল ও গরিব মানুষ : সারাদেশে তীব্র শীত ৩ জনের মৃত্যু কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ

পৌষের প্রথম দিনেই সারাদেশে তীব্র শীত পড়েছে। আগের দিনের চেয়ে গতকাল প্রায় সব বিভাগেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমেছে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৯ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সব বয়সী মানুষই তীব্র শীতে কাবু হয়ে পড়েছে। তীব্র শীতে নীলফামারী ও দিনাজপুরে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে কুয়াশার কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে রাত দেড়টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। মাওয়া-


কাওড়াকান্দি নৌরুটে ফেরি রাত সাড়ে ৩টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। প্রধান প্রধান নদীগুলোতে লঞ্চসহ নৌযান চলাচলও ব্যাহত হয়েছে। রাতে মাঝনদীতে আটকা পড়ায় লঞ্চ যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
সারাদেশে শীতের তীব্রতা কেমন জানতে চাইলে, আবহাওয়া অধিদফতর ডিউটি ফোরকাস্ট অফিসার রাশেদুজ্জামান আমার দেশ-কে জানান, মঙ্গলবার থেকে তীব্র শীত পড়তে শুরু করলেও গতকাল তীব্রতা বেড়েছে। যা আরও দুই থেকে তিনদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার পৌষের প্রথম দিনে শীতের তীব্রতা বেশি ছিল। গত বছর এ দিনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রংপুরে ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গতকাল ছিল ৯ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ১ পৌষে ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও গতকাল ছিল ১২ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
একদিনেই বেড়ে গেল শীতবস্ত্রের দাম : গত বুধবারেও ঢাকার শীতবস্ত্রের দোকানে ক্রেতা ছিল না। গতকাল মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য। বেশ ক্রেতার ভিড় জমেছে। গত বছরের তুলনায় বুধবার শীতের পোশাক ভেদে একশ’ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম হাঁকছিল বিক্রেতারা। অথচ গতকাল বুধবারের চেয়েও দাম বেড়ে গেল এক থেকে দুইশ’ টাকা। কম্বলের দামও মান ভেদে বেড়েছে পিস প্রতি তিনশ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।
শীতে কাহিল ছিন্নমূল ও গরিব মানুষ : গতকাল রাতে ঢাকার কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে দেখা গেছে সারি সারি ছিন্নমূল ভাসমান মানুষ কুচি মুচি জড়ো সড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তাদের গায়ে ছেঁড়া কাঁথা, পুরনো জীর্ণ কম্বল ও এক সঙ্গে দু-তিনটি শার্ট। কেউ কেউ কাগজ জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন। একই চিত্র দেখা গেছে কমলাপুর রেলস্টেশন, হাইকোর্ট এলাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ধানমন্ডি লেক এলাকা, ফার্মগেট, মহাখালীসহ বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতগুলোতে।
তিনজনের মৃত্যু : বার্তা সংস্থা বাংলানিউজ জানিয়েছে, গতকাল তীব্র শীতে নীলফামারীতে ২ জন ও দিনাজপুরে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পুর্বছাতনাই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গরম কাপড়ের অভাবে আনছার আলী (৭০) ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাহেরা খাতুন (৮৫) শীতে গতকাল মারা গেছেন। এছাড়াও দিনাজপুরের পার্বতীপুরে তীব্র শীতে অজ্ঞাত পরিচয় এক ছিন্নমূল ব্যক্তির (৫২) মৃত্যু হয়েছে। পার্বতীপুরের এসএসএই-এর (সাবেক আইডব্লিউ অফিস) পাশে রেল ওয়াগনের নিচ থেকে সকালে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
এক সপ্তাহে শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু : দেশব্যাপী তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতজনিত রোগে গত এক সপ্তাহে ৬ শিশুসহ বিভিন্ন স্থানে ১১ জনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেড়েছে। গতকাল তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এটাই চলতি মৌসুমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বলে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। এদিকে গত এক সপ্তাহে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শীতের তীব্রতা বাড়লেও সরকারি কোষাগারে এখনও শীতবস্ত্র পৌঁছেনি।
নীলফামারীতে ৩ জনের মৃত্যু : দেশের সর্বউত্তরের জনপদ হিমালয়ের পাদদেশের জেলা নীলফামারীতে কয়েকদিন ধরে বইছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। জেলার ডিমলা উপজেলায় তীব্র শীতে এখন পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের আনসার আলী (৭০), গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের সাহেরা খাতুন (৮৫) ও ৫নং ওয়ার্ডের হায়াত আলী (৭৫)। শীতজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
চিলমারীতে একজনের মৃত্যু : কুড়িগ্রামের চিলমারীতে গত দু’দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় খেটে খাওয়া মানুষ কাহিল হয়ে পড়েছে। বুধবার রাতে উপজেলার ছড়ারপাড় এলাকার বদিউজ্জামান (৭০) শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
খুলনাঞ্চলে চারদিনে তাপমাত্রা কমেছে ৬ ডিগ্রি : খুলনাঞ্চলে চারদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমেছে প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা আরও বাড়বে বলে খুলনা আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আযাদ জানান, গতকাল সকাল ১১টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দিনাজপুরে সবজির বাজারে ধস, মৃত্যু একজনের : দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় নবান্নের উত্সব শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে হাড় কাঁপানো তীব্র শীত। ঘন কুয়াশা আর রাতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহে খেটে খাওয়া মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে। শীতজনিত রোগে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কুয়াশার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবজি ক্ষেত ও বীজতলা।
এতে পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন যানবাহন নদীর দুই তীরে আটকা পড়ে। কুয়াশা ও শীতে এসব যানবাহনের যাত্রীদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে।
বাজিতপুরে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া আক্রান্ত অর্ধশত : কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৫ দিনে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। তবে চিকিত্সক সঙ্কটে তারা যথাযথ চিকিত্সা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এসব রোগীর বেশিরভাগই দিনমজুর অথবা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।
কাউনিয়ায় বিতরণ করা হয়নি শীতবস্ত্র : রংপুরের কাউনিয়ায় শীতবস্ত্রের অভাবে কনকনে শীতে কাহিল হয়ে পড়েছেন দুস্থ ও অসহায় মানুষ। বিশেষ করে, চরাঞ্চলের দুস্থ ও অসহায় মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি।
নওগাঁয় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দেড় লাখ আদিবাসী : নওগাঁর পত্নীতলাসহ আশপাশের উপজেলায় গত তিনদিন ধরে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। শিশু-বৃদ্ধসহ জেলায় বসবাসরত প্রায় দেড় লাখ আদিবাসী পড়েছে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে।
স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রিতা সপুয়ার জানান, শীতের কারণে শিশুরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ফলে স্কুলে হাজিরা অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং দেরিতে ক্লাস শুরু করতে হচ্ছে।
ইসলামপুরে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না লোকজন : ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বিধৌত জামালপুরের ইসলামপুরের মানুষ ঘন কুয়াশায় ও ঠাণ্ডা বাতাসে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। গরম কাপড়ের অভাবে এলাকার দরিদ্র মানুষ শীতে কাহিল হয়ে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে শীতজনিত নানা রোগ।

No comments

Powered by Blogger.