রাজশাহীর গ্রামে বিশাল ফাটল, জনমনে আতঙ্ক by সরদার এম. আনিছুর রহমান

রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার ভূ-পৃষ্ঠে হঠাত্ বিশাল বিশাল ফাটল দেখা দিচ্ছে। মাঝে মধ্যেই হঠাত্ করে দিনে কিংবা রাতে এ ধরনের ফাটল ও ভূমিধসে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূ-গর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং পানির রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ভূমির এ ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষণীয়। মরণফাঁদ ভারতের ফারাক্কা বাঁধের উজানে গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার,


আশঙ্কাজনক হারে বৃষ্টি কমে যাওয়া এবং বিশ্ব জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে এমনটি ঘটছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের চাঁদপুর নওপাড়া এলাকায় প্রায় ৫শ’ মিটার এলাকাজুড়ে মাটিতে বিশাল ফাটল দেখা দেয়। রাতের আঁধারে হঠাত্ করে বিশাল এলাকাজুড়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর ফাটল দেখা দেয়ায় এলাকাবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। অন্তত ৫০টি বাড়ির বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে অন্যত্র সরে পড়েন। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার উত্সুক মানুষ সেখানে ভিড় করে। এ সময় বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হৈচৈ হয়। পরবর্তীতে এ বিষয়টি একেবারেই ঝিমিয়ে পড়ে। তবে ভূ-তত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এলাকাজুড়ে ওই বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হতে পারে।
এলাকাবাসী জানায়, চাঁদপুর নওপাড়া গ্রামের একটি বাগানে দুই বছর আগে ছোট্ট ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় লোকজন বিষয়টিকে প্রথমদিকে সাধারণ ব্যাপার মনে করে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। পরবর্তীতে গত বছরের ১৫ এপ্রিল দিবাগত রাতে কালবৈশাখীর ঝড়ের পর সেই ফাটল বড় ও গভীর হয়ে দেখা দেয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
এলাকাবাসী জানায়, ঝড়ের পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় একটা গর্ত দেখা যায়। কাছে গিয়ে দেখা যায় সেটি গর্ত নয়। আগের ছোট ফাটলটি বড় আকার ধারণ করেছে। খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গ্রামবাসী জানান, ফাটলটি উপর থেকে না বোঝা গেলেও ভিতরে খুঁড়ে দেখা গেছে, বিশাল চওড়া ও গভীর ফাটল।
ওই গ্রামের আসাদুল হক জানান, ফাটলটি উপর থেকে ছোট মনে হলেও ভিতরে বেশ চওড়া ও গভীর। স্থানীয় বাসিন্দা মতিউর রহমান, আফজাল হোসেন ও সাইফুল ইসলাম জানান, ফাটলের লাইন ধরে কয়েক স্থানে তারা খুঁড়ে দেখেছেন। কোথাও গভীরতা ৫ থেকে ৭ ফুট আবার কোথাও তার চেয়েও বেশি। হঠাত্ মাটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় ওই গ্রামের অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত। এই ফাটল আগামীতে বড় আকার ধারণ করলে তাদের বাড়িঘর ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।
একই বছরের ২৩ মে গোদাগাড়ীর সারাংপুর ও মহিশালবাড়ী-রেলবাজার গ্রামের ভূ-পৃষ্ঠে বিশাল আকারের ফাটল দেখা দেয়। এতে ওই এলাকায় ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। উত্সুক এলাকাবাসী ফাটল দেখার জন্য দিন-রাত ভিড় জমায়।
পৌর এলাকার পদ্মা নদী থেকে ২শ’ ফুট দূরে সারাংপুর গ্রামের প্রায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ও মহিশালবাড়ী-রেলবাজার গ্রামের বিডিআর ক্যাম্পের পিছনে বিভিন্ন স্থানে ১ মিটার গভীর পর্যন্ত ফাটলের সৃষ্টি হয়। পদ্মা ও মহানন্দা নদীর নিচের পাড় বোল্ডার দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা থাকলেও বাঁধের কোনো ক্ষতি হয়নি। সারাংপুর গ্রামের মুকুল জানায়, সকালে তার পাকা ও মাটির তৈরি বাড়ি এবং আম বাগানে ছোট আকারের ফাটল দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে সেটা বড় হতে থাকে এবং এনামুল, সাইদুর, কার্তিকের বাড়িসহ একটি মসজিদের দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। মহিশালবাড়ী গ্রামের টগরের বাড়ির সামনে ও মালেক মিস্ত্রির বাড়ির ভিতরে ফাটল সৃষ্টি হয়। মালেক জানান, প্রচণ্ড খরায় তাদের বাড়ির সামনে একটি ফাটল দেখা দেয় এবং ওইসব জায়গায় প্রচণ্ড উত্তাপ ছিল। বৃষ্টির পরে ফাটলগুলো আরও গভীর হতে দেখা যায়।
গ্রাম দুটিতে ফাটলের কারণে শতাধিক পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যে কোনো সময় বাড়ি-ঘর ভেঙে নিচে দেবে বা বসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। মুকুলের স্ত্রী জানান, তারা কয়েক দিন নিদ্রাহীন রাত পার করেন এবং শিশু বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের মধ্যে থাকতে পারছেন না—যে কোনো সময় তাদের বাড়ি নদীগর্ভে চলে যেতে পারে, এ আতঙ্কে। ওই সময় গোদাগাড়ী পৌর মেয়র জানান, নদী হতে এলাকাটি কাছে হওয়ার কারণে জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য বলা হয়েছে।
এর আগে ২০০৯ সালের ২০ জুলাই রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালী সিনেমা হলের পাশের আম বাগান এলাকায় বেশ কয়েকটি ভবন দেবে গিয়ে দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। এলাকাবাসী জানান, গভীর রাতে বিকট শব্দ হয়ে আলালের বাড়ির দেয়ালে ফাটল ধরে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে গেলে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। পরে এলাকাবাসী দেখতে পান, পাশের আরও দুটি ভবন দেবে গেছে এবং পুকুরের পানিও কমে গেছে। এ ঘটনা দেখতে ওই এলাকায় লোকজন ভিড় করে। এছাড়া এ ঘটনার পর ওই এলাকার কয়েকটি নিচু জায়গা ফেটে গিয়ে সেখান থেকে শব্দ করে বাতাস বের হয়।
এদিকে গত বছর রাজশাহীর বাঘায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ৮-১০ বছর আগে বিদেশি বিজ্ঞানীদের পিলার পুঁতা পরীক্ষিত জমিতে হঠাত্ করেই ভূমিধস দেখা দেয়। বাঘার তেথুলিয়া এলাকার শিকদারপাড়া গ্রামে প্রায় এক কাঠা জমিতে মারাত্মক ভূমিধস হয়েছে। এ ধসে এলাকায় ৬-৭ হাতের বেশি গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে। দেবে গেছে জমির বেশ কিছু অংশ। হেলে পড়েছে পাশের গাছপালা। জমির মালিক আব্দুস সাত্তার জানান, জমিতে গিয়ে তিনি প্রথম ভূমিধস দেখতে পান। ঘটনার মাসখানেক আগে জমিটা দেবে যাচ্ছে বলে মনে হলেও তিনি এতটা গুরুত্ব দেননি। তিনি জানান, তার বয়স যখন ১৭-১৮ বছর, সে সময় বিদেশি বিজ্ঞানীরা সাদা পোশাক পরে হেলিকপ্টারে এসে তার পাশের জমিতে নামেন। যা দেখার জন্য এলাকার অনেক মানুষ সেখানে ভিড় করেছিল।
আব্দুস সাত্তারসহ এলাকার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সে সময় বিজ্ঞানীরা এসে উক্ত জমিতে মূল্যবান খনিজসম্পদ আছে সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জমিতে পর পর দু’টি বোমা মারেন। এরপর প্রায় ৪-৫ শত হাত লম্বা শিক মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে শিকটি ওঠানোর পর জিহ্বায় মাটি নিয়ে তা পরীক্ষা করেন এবং জমির উত্তর সীমানায় একটি ঢালাই পিলার পুঁতে রেখে যান। পিলারটি কে বা কারা এক বছর আগে চুরি করে নিয়ে গেছে। বর্তমানে সেখানেই ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মৃণাল কান্তি রায় বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে এ ধরনের অনেক ফাটল রয়েছে। পাশে নদী থাকলে ওই সৃষ্ট ফাটল থেকে পুরো এলাকা নদীগর্ভে ধসে যেতে পারে। তিনি বলেন, হঠাত্ ভূমিকম্প হলে এই ফাটল বিশাল আকার ধারণ করে এলাকায় ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে।
একই বিভাগের অপর শিক্ষক ড. সুলতানুল ইসলাম বলেন, মাটির নিচে কয়লার প্রাথমিক স্তর থেকে পানি শুকিয়ে গেলে ভূ-উপরিস্থ মাটিতে ফাটল দেখা দিতে পারে। এটি তেমনটিই হতে পারে বলে তিনি ধারণা করেন।
রাবির ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ইমামুল হক বলেন, সাধারণত রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় ১০ থেকে ১২ ফুট নিচে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাওয়া যেত। এখন সেই স্তর অন্তত ৪০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ার কারণে উপরি অংশে বড় ধরনের গ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এই ফাটল হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

No comments

Powered by Blogger.