বিজয়ের ৪০ বছর-নতুন সূর্য আনুক নতুন ভোর

জ ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন আজ। আজকের এই দিনেই বাঙালি জাতি নিজস্ব জাতিসত্তার পরিচয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আজকের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে যুদ্ধের শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধের সমাপ্তিতে আজকের এই দিনে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশ নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয় বিশ্বের দরবারে।
৯ মাসের রক্তঝরা সংগ্রামের পর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় আজকের এই দিনে। এই বিজয় অর্জনের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ। এই বিজয় অর্জন করতে গিয়ে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে দুই লাখ মা-বোনকে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের আত্মত্যাগ ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনকে আজ আমরা স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়। সশ্রদ্ধচিত্তে আজ আমরা স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি তাজউদ্দীন আহমদ ও মুজিবনগর সরকারের নেতাদের। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নসহ যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে রণাঙ্গনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল, তাদের অবদানকেও আজ আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। আর উষ্ণ অভিনন্দন জানাই সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যাঁরা জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের বিজয়, ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার সূর্য।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। শুরু করেছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বীর বাঙালি। অনভ্যস্ত হাতেই তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। সম্মুখসমরে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর। শুধু যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গেই লড়াই করতে হয়েছিল তা নয়, বাঙালিকে লড়তে হয়েছিল হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের বিরুদ্ধেও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশীয় কিছু লোককে নিয়ে গড়ে তুলেছিল তাঁবেদার বাহিনী। সেই তাঁবেদার আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সেদিন অস্ত্র ধরেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। সেই বাংলাদেশবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আজও সক্রিয়। একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিতই শুধু নয়, পরাজিত ও দেশান্তরিত সেই যুদ্ধাপরাধীদের আজ প্রচারমাধ্যমে মাথা উঁচু করে কথা বলতে শোনা যায়। যুদ্ধাপরাধের সংগঠকদের বলতে শোনা যায়, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল।
আজ বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে অন্য রকম পরিবেশে। আর কয়েক দিন পরই বর্তমান মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছে। কিন্তু এখনো জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে। তবে সেই বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি চিহ্নিত মহল। বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তারা। এমনকি এই চক্রটি বিচার বানচাল করার জন্য আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলেও জানা গেছে। একাত্তরের ঘাতকদের নির্মমতার শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি দেশের মানুষও শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়। দেখতে চায় সেই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি স্বপ্ন ছিল। একটি স্বপ্ন নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৮ বছরে এসেও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কুচক্রী মহল এখনো সক্রিয়। গড়ে তোলা যায়নি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। আসেনি অর্থনৈতিক মুক্তি। নিশ্চিত করা যায়নি মানুষের পাঁচ নূ্যনতম মৌলিক অধিকার। এমন অবস্থায় আজ বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে সারা দেশে। বিজয়ের এই দিনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে স্মরণ করি। আজ আবার আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে। মুক্ত স্বদেশ যুদ্ধাপরাধীমুক্ত হবে অচিরেই_সেই প্রত্যাশায় নতুন একটি দিনের অপেক্ষায় থাকব আমরা। সেই নতুন দিনের সূর্য অন্য রকম একটি সকাল উপহার দেবে আমাদের_বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকীতে এটাই জাতির প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.