এবার গুপ্তহত্যার শিকার বিএনপি নেতা নাজমুল : কাল যশোরে হরতাল : জনপ্রিয় নেতাদের খুন-গুম করা হচ্ছে : তরিকুল

বার গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও যশোর জেলা কমিটির অর্থবিষয়ক সম্পাদক নাজমুল ইসলাম। রাজধানীর মোহম্মদপুর থানার সামনে থেকে বুধবার গভীর রাতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা গাড়িসহ তাকে অপহরণ করে। পরে গতকাল সকালে গাজীপুরের সালনায় নাজমুলের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। নাজমুল হত্যার প্রতিবাদে বিএনপি আগামীকাল (শনিবার) যশোরে জেলাব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের


ডাক দিয়েছে। এছাড়া নাজমুলসহ অব্যাহত খুন-গুমের প্রতিবাদে গতকাল যশোর ও ঝিকরগাছায় স্থানীয় বিএনপি বিক্ষোভ দেখিয়েছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ-র্যাবের শরণাপন্ন হয়েও নাজমুলকে উদ্ধারে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
বুধবার রাতে নাজমুল ইসলাম সপরিবারে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন রাজধানীর মিরপুরে। সেখান থেকে পরিবার-সদস্যরা একটি গাড়িতে এবং নাজমুল নিজে আরেকটি গাড়িতে তাদের ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরছিলেন। পথে মোহম্মদপুর থানার কাছে অজ্ঞাত একদল লোক তার গাড়ি থামায়। এ সময় গাড়ির মধ্যে নাজমুল ইসলাম বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী টিএস আইয়ুবের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। টিএস আইয়ুবকে তিনি দুর্বৃত্তদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানাতে পারেন। এরপরই তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব জানান, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি নাজমুলের স্ত্রী সাবিরা ইসলাম মুন্নিকে জানান। মুন্নি, আইয়ুব ও কৃষক দল নেতা মহসিন কবির এরপর যান মোহম্মদপুর থানায়। সেখান থেকে তারা কোনো সহযোগিতা পাননি। এরপর তারা যান র্যাব-২ কার্যালয়ে, সেখান থেকে উত্তরায় র্যাব হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু পুলিশের মতো র্যাবও কোনো সহযোগিতা করেনি। তারা সবাই লিখিত অভিযোগ করে বাড়িতে ফিরে যেতে বলেন এবং জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার আগে কোনো সহযোগিতা দেয়া সম্ভব নয়।
নাজমুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, সারারাত বিএনপি নেতাসহ পরিবার-সদস্যরা ঢাকা নগরীর যেসব স্থানে সম্প্রতি লাশ উদ্ধার হচ্ছে, সেসব জায়গা ও হাসপাতালগুলো তন্ন তন্ন করে খোঁজেন। পরে গতকাল সকাল ৭টার দিকে যশোর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন ফোন করেন নাজমুল ইসলামের নম্বরে। তখন ফোনটি রিসিভ করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। সে নিজেকে গাজীপুরের একটি গার্মেন্টের কর্মী পরিচয় দিয়ে জানায়, গাজীপুরের সালনায় রাস্তার ধারে একটি লাশের পাশে মোবাইল ফোনটি পড়ে থাকতে দেখে সে হাতে নেয়। এ খবর জানতে পেরে নাজমুলের পরিবার-সদস্যরা গাজীপুরে ছুটে গিয়ে দেখেন সেখানে তার লাশ পড়ে আছে। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে গাজীপুর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায় ময়নাতদন্তের উদ্দেশে। গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘দুর্বৃত্তরা নাজমুলকে হত্যার পর গাজীপুরের দক্ষিণ সালনা এলাকায় লাশ ফেলে যায়। নাজমুলের মৃত্যুর খবরে ঢাকায় তার ধানমন্ডির বাসায় স্ত্রী ও সন্তানসহ আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। যশোরে নাজমুলের মা ছেলের জন্য মাতম করে বিলাপ করছিলেন।
এদিকে নাজমুল অপহরণ ও পরে তার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে ঝিকরগাছায়। বিএনপির শত শত নেতাকর্মী ছুটে আসে নাজমুলের কীর্তিপাড়ার বাড়িতে। সকাল ১০টায় ঝিকরগাছায় মিছিলও বের করে দলটির নেতাকর্মীরা। বিকালে বিশাল একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয় ঝিকরগাছায়। পরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে দলের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপু নাজমুল হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
দুপুর ১২টায় যশোর জেলা বিএনপি স্থানীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বিএনপির জনপ্রিয় নেতাদের একের পর এক খুন-গুম করা হচ্ছে। খুন-গুমের এই মিছিলে সর্বশেষ যোগ হলেন দলের তরুণ নেতা নাজমুল ইসলাম।
নাজমুল হত্যার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামীকাল শনিবার যশোর জেলায় পূর্ণদিবস হরতাল এবং গতকাল থেকে তিনদিন কালো ব্যাজ ধারণ ও দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন। এছাড়া বিজয় দিবস উপলক্ষে যশোর জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করা হয় নাজমুলের মৃত্যুর কারণে। তবে ১৬ ডিসেম্বর শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের কর্মসূচি যথারীতি পালন করবে বিএনপি। সংবাদ সম্মেলন শেষে বিএনপি শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে বিকালে আরেকটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে।
সংবাদ সম্মেলনে তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, বিরোধীদলীয় নেতার খুলনা বিভাগীয় রোডমার্চ কর্মসূচির অভূতপূর্ব সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এই রোডমার্চের অন্যতম সফল সংগঠক নাজমুল ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদা, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, দেলোয়ার হোসেন খোকন, নগর সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র মারুফুল ইসলাম, মোহাম্মদ নূর-উন-নবী, আবদুস সালাম আজাদসহ আট উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা।
নিহত নাজমুলের স্ত্রী সাবিরা ইসলাম মুন্নির বক্তব্য : বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে তিনি সন্তানকে নিয়ে মিরপুর সেতারা কমিউনিটি সেন্টারে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যান। নাজমুল তার ঢাকা অফিস থেকে অন্য একটি গাড়িতে সহচর কামালকে নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। রাত ১১টার দিকে সাবিরা ইসলাম মুন্নি তার সন্তানকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। একই সময় আলাদা একটি গাড়ি নিয়ে নাজমুল কমিউনিটি সেন্টার থেকে একাই বের হয়ে যান। অপহৃত হওয়ার সময় বিএনপি নেতা টিএস আইয়ুবের সঙ্গে নাজমুলের ফোনে কথা হচ্ছিল।
মুন্নি বলেন, কামাল নামে এক সহচর সবসময় নাজমুলের সঙ্গে থাকত। কিন্তু গতকাল নাজমুল যখন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাসার উদ্দেশে যান, তার ঠিক আধাঘণ্টা আগ থেকে কামাল নিখোঁজ ছিল। সারারাত কামালের ফোন বন্ধ ছিল।
ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তাই কাল হলো নাজমুলের : বয়স ৪০ কি ৪২। টগবগে তরুণ। রাজনৈতিক জীবনও দীর্ঘ নয়, অথচ নাজমুল ইসলাম নামে এই তরুণ ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় ছিলেন ঝিকরগাছা-চৌগাছার বিস্তীর্ণ জনপদে। গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে চিরতরে শেষ হয়ে গেল তার জৈব জীবন, রাজনৈতিক জীবন।
ঝিকরগাছা শহরের কীর্তিপুরে জন্ম নাজমুল ইসলামের। পরিবারের সদস্যরা সবাই বিএনপিপন্থী। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঝিকরগাছা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র নাজমুল ইসলাম জড়িয়ে পড়েন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। ছাত্রত্ব শেষ হতে না হতেই শুরু করেন ব্যবসা। তখন খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় নন নাজমুল। আমদানি-রফতানি ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থকড়ির মালিক হন তিনি। আর্থিক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মনোনিবেশ করেন রাজনীতিতে।
ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সেক্রেটারি মোর্তজা এলাহী টিপু জানান, ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে নাজমুল যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আলোচনায় চলে আসেন। ঝিকরগাছা-চৌগাছার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক গণসংযোগের মাধ্যমে নিজ কর্মী বাহিনী তৈরি করেন। পরে অবশ্য ওই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকেননি নাজমুল ইসলাম। রাত-দিন চষে বেড়াতে থাকেন নির্বাচনী এলাকা।
১৯৭৯ সালের পর থেকে বিএনপি যশোর-২ আসনটি পায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট আসনটিতে মনোনয়ন দেয় জামায়াতে ইসলামী নেতা মুহাদ্দিস আবু সাইদকে। নাজমুলের দাবি ছিল, আসনটি বিএনপির ঘরে আসতে পারে শুধু তাকে মনোনয়ন দিলে। সে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন চান; কিন্তু এবারও ব্যর্থ হন তিনি। হতাশ হয় তার বিশাল কর্মী বাহিনী।
নির্বাচনের পর নাজমুল ইসলাম নিজেকে রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে নিতে ও সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ব্যাপকভাবে তত্পর হয়ে ওঠেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পরপরই তিনি যশোর জেলা বিএনপির সম্মেলনে অর্থবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ঝিকরগাছা-চৌগাছা অঞ্চলের বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন-নিপীড়ন। নাজমুল এ সময় বুক দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেন দলীয় নেতাকর্মীদের। এরই মধ্যে পুলিশ আটক করে তাকে ঝিকরগাছা থানা হেফাজতে রাখে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ হাজারু নেতাকর্মীর দাবির মুখে পুলিশ তাকে থানা থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর পরের দু’বছর ঝিকরগাছা ও যশোরের দলীয় কর্মসূচিগুলোতে নাজমুল ইসলামকে দেখা গেছে একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে। সর্বশেষ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার খুলনা অভিমুখী রোডমার্চে নাজমুল ইসলাম সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গত ২৭ নভেম্বর সকালে যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ছিল খালেদা জিয়ার পথসভা। নাজমুল ইসলাম ভোর ৪টার আগে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে হাজির হন পথসভাস্থলে। নাজমুল ইসলামদের মতো রাজনৈতিক কর্মীদের সক্রিয়তায় বেগম জিয়ার পথসভা শেষাবধি জনসমুদ্রে রূপান্তরিত হয়।
বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, নাজমুল ইসলাম ছিলেন তার এলাকায় ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার অধিকারী। এত অল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে এত জনপ্রিয়তা অর্জন সত্যিই দুঃসাধ্য। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে বলে মনে করেন তরিকুল ইসলাম।
নাজমুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আসছে নির্বাচনে যশোর-২ আসন থেকে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছিলেন নাজমুল ইসলাম। সেই লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি তত্পরতা চালিয়ে গেছেন। একদিকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংগঠনকে গতিশীল রাখা, অন্যদিকে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি। নাজমুলের মৃত্যুতে ঝিকরগাছা-চৌগাছা নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি নেতৃত্বশূন্যতায় পড়বে বলে মনে করেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।

No comments

Powered by Blogger.