ঝলমলে সাকিবেও মলিন বাংলাদেশ by সঞ্জয় সাহা পিয়াল

দেশের কেউ নন, পাকিস্তান থেকেই এক সমর্থক মজা করে ক্রিকইনফো ওয়েবসাইটে সাকিব আল হাসানের নাম দিয়েছেন 'সাকিব আল বাংলাদেশ'। এক ইনিংসে একশ' এবং পাঁচের বেশি উইকেট নেওয়াদের তালিকায় প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে সাকিবই গতকাল নাম লিখিয়েছিলেন। গত পনেরো বছরে সাকিব বাদে এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস আর ভারতের অশ্বিন। ঢাকা টেস্টের অন্তিম সময়ে সাকিবকেই কেবল যোগ্য ছেলের


মতো বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। বাকিদের মধ্যে তো ছিল কেবলই চুলছেঁড়া বিরক্তি। সকালে ক্যাচ মিসের প্রতিযোগিতা আর বিকেলে তামিম-মাহমুদুল্লাহর হম্বিতম্বি শট। ৪৭০ রানে পাকিস্তানের অল আউট হওয়ার পর দেড় দিন বাকি ছিল নিজেদের প্রায়শ্চিত্ত খণ্ডানোর জন্য; কিন্তু ৯৫ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরই প্রমাণিত হয় মিথ হয়ে যাওয়া সেই পুরনো কলঙ্কটি_ বাংলাদেশ কেবল এক ইনিংসই ভালো খেলে। প্রথম ইনিংসে ৩৩৮ রান তোলার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তার ধারে-কাছে যাওয়ার মৃদু আশাটি ছিল ভুল। যেমনটা ছিল তামিমের কাছ থেকে হুক শট দেখতে না পাওয়ার ইচ্ছাটা। দিন শেষে মুশফিক-নাসিররা ৫ উইকেটে ১১৪ রান তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু আজ হারের প্রহর কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন তারা? কোচ স্টুয়ার্ট ল যদিও বলেছেন হার এড়ানো সম্ভব। তবে তার সঙ্গে অনেকগুলো যদি আর কিন্তু মিশিয়েছেন তিনি। 'যদি এ দুই ব্যাটসম্যান কাল লম্বা ইনিংস খেলতে পারে, যদি দুই থেকে আড়াই সেশন আমাদের ছেলেরা ব্যাটিং করতে পারে, তাহলে এ টেস্ট বাঁচানো সম্ভব।'
ভালো ভালো কথা বলতে হয় দেখেই হয়তো স্টুয়ার্ট ল এমনটা বলেছেন। আদতে গতকাল তামিম-মাহমুদুল্লাহর শট সিলেকশন নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত বাংলাদেশ ড্রেসিংরুম। পাকিস্তানিরা যেখানে ঠাণ্ডা মাথায় ১৫৪.৫ ওভার ব্যাটিং করে ৪৭০ রান তুলেছেন। রান তোলার গড় তাদের ২.৮১। গোটা ইনিংসে তারা সিঙ্গেল নিয়েছেন ১৪৬টি। সেখানে বাংলাদেশিরা গতকাল এক সেশন হাতে পেয়েই 'সব উল্টে দেব' জাতীয় ব্যাটিং করেছেন। ১১৪ রানের মধ্যে মাত্র ১৬টি সিঙ্গেল নিয়েছেন তামিমরা। এর মধ্যে ১৯টি বাউন্ডারির সঙ্গে একটি বিশাল ছক্কাও ছিল। যেখানে পাকিস্তানের গোটা ইনিংসে কোনো ছক্কার দেখা পায়নি মিরপুর। এমন নয় যে তারা পারেন না, মিসবাহরাও পারতেন ছক্কা হাঁকাতে; কিন্তু তাদের কাছে রান তোলার চেয়ে উইকেটে সময় কাটানোটাই বড় মনে হয়েছে। যদিও পাকিস্তানিদের সময় কাটানোর ব্যাপারে বাংলাদেশি ফিল্ডাররা মদদ দিয়েছেন। আগের দিনের চারটির সঙ্গে গতকাল আরও তিনটি ক্যাচ মিসের ঘটনা ঘটেছে। মিড অনে রবিউল মিসবাহর একটি দুধ-ভাত ক্যাচ ফেলেছেন, স্লিপে দাঁড়িয়ে অমনোযোগী মাহমুদুল্লাহ ফেলেছেন আসাদ শফিকের ক্যাচ আর মিড উইকেটে আদনানের ক্যাচ ছেড়েছেন ইলিয়াস সানি। তারপরও সাকিব একাই এদিন তুলে নিয়েছিলেন শেষ চার উইকেট। ইতিহাস বলছে, গত পনেরো বছরে একই ইনিংসে সেঞ্চুরি আর পাঁচের বেশি উইকেট পেয়েছিলেন কেবল জ্যাক ক্যালিস আর অশ্বিন। গতকাল তাদের পাশে নিজের নামটি লিখে নিয়েছেন সাকিব প্রথম ইনিংসে ১৪৪ রান আর ৮২ রানে ৬ উইকেট তুলে।
কেউ কেউ আশাও করেছিলেন, এই সাকিবই পারবেন ঢাকা টেস্টের খাদ থেকে তার দলকে টেনে তুলতে; কিন্তু প্রথম ইনিংসে ২৪২ বল মোকাবেলা করার পর ৪০.৫ ওভার হাত ঘুরিয়ে বোলিং করা সাকিবের পক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে দম নেওয়ার মতো যথেষ্ট অক্সিজেন ছিল না। ৬ রান করেই তাকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দিতে হয়। সাকিবকে ক্লান্তির কারণে ভুল শটের জন্য ছাড় দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তামিম? হেলমেটে লাগা বলে আম্পায়ার তাকে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ঠিকই। তবে এটাও তো ঠিক, প্রথম ইনিংসে গুলকে হুক করার মতো ভুল গতকালও করেছেন তামিম। আর শাহরিয়ার নাফীস প্রথম বলেই ব্যাকফুটে গিয়ে বোকামি করেছেন শূন্য রানে ফিরে এসে। নাজিমউদ্দিন শিকার হয়েছেন রেহমানের নিচু হয়ে আসা বলটি বুঝতে না পেরে। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেও দিন শেষ হওয়ার মাত্র ১৩ ওভার আগে চিমার অফ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে যাওয়া বলটি তুলে মারার কি কোনো দরকার ছিল সহ-অধিনায়কের? প্রশ্নগুলো ড্রেসিংরুমে তাকে কোচ স্টুয়ার্ট ল নিজেও করেছিলেন। উত্তর দিতে গিয়ে ভুল স্বীকার করেছেন; কিন্তু এভাবে ভুল করা এবং তারপর সেটা স্বীকার করে আবার ভুল করার সংস্কৃতি তো অনেক পুরনো। এ থেকে বের হতে না পারলে হাতের সোনাও একদিন ক্ষয় হয়ে লোহা হয়ে যাবে এই ঢাকা টেস্টের মতোই।

No comments

Powered by Blogger.