নড়বড়ে গণপরিবহন ব্যবস্থা-রাজধানীতে তীব্র বাস সংকট- যাত্রীদের অসহনীয় দুর্ভোগ-যাত্রীদের অসহনীয় দুর্ভোগ by রাশেদ মেহেদী

রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিআরটিসির হাতেগোনা কয়েকটি বাস ছাড়া নূ্যনতম সুষ্ঠু পরিবেশে যাতায়াতের সুবিধা আছে_ এমন যানবাহন পাওয়া যায় না রাজধানীতে। বিকল্প যানবাহন না থাকায় লক্কড়-ঝক্কড় বাসেই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। ট্যাক্সিক্যাব পাওয়াও দুষ্কর। যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোতে ওঠার মতো পরিবেশ থাকে না। এ ছাড়া সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া আকাশচুম্বী। খোদ পরিবহন


নেতারাই বলছেন, রাজধানীর গণপরিবহনে এ ধরনের নজিরবিহীন বিপর্যয় গত এক দশকে চোখে পড়েনি। পরিবহন নেতাদের দাবি, রাজধানীতে বাস সার্ভিস এখন আর লাভজনক নয়। এ কারণে তিন বছরে দু'একটি কোম্পানি ছাড়া আর নতুন বাস নামেনি। পুরনো বাস যেগুলো সচল
ছিল, সেগুলোও দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ পরিবহন মালিকরা জানান, পরিবহনে ত্রিমুখী চাঁদাবাজি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার কারণেই ছোট ছোট মালিক পরিবহন ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছেন। প্রভাবশালী মালিকদের কারণেও অনেক রুটে নতুন করে বাস নামছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বয়হীনতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণেই পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় চলে গেছে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বলছেন, একদিকে বাসের আসনে বসা যায় না, ভেতরে ভালোভাবে পা রাখার জায়গাও নেই, এর মধ্যে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ ভাড়াও দিতে হচ্ছে বেশি। তাদের অভিযোগ, রাজপথের এ সাময়িক যন্ত্রণা সরকারের কেউই দেখছেন না।
যে দৃশ্য এখন সবার চেনা : সকালে কিংবা বিকেলে, সন্ধ্যায় এমনকি রাত ১২টায়ও রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, কাকরাইল, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুর, খিলক্ষেত, উত্তরা প্রভৃতি এলাকায় দেখা যায় বাসের অপেক্ষায় শত শত মানুষ। বাস নেই। একটা বাস আসামাত্র শত শত মানুষের শুরু হয় বাসে ওঠার অন্যরকম যুদ্ধ। বাসে উঠতে গিয়ে প্রায়ই অনেকের খোয়া যাচ্ছে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ। বর্তমানে রাজধানীতে যেসব বাস চলছে তার প্রায় সবটিতে সংযোজন করা হয়েছে অতিরিক্ত আসন। ৩০ আসনের মিনিবাসে ৪০ থেকে ৪৫টি এবং ৫২ থেকে ৬০ আসনের বড় বাসে ৭০ থেকে ৮০টি আসন বসানো হয়েছে। ভেতরে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে থাকেন ৪০ থেকে ৫০ জন। গায়ে গা, পায়ের ওপর পা, ছোট্ট হাতলের ওপর অসংখ্য হাত। চালক একবার ব্রেক কষলেই হুমড়ি খেয়ে বাসের ভেতর পড়ে যাচ্ছেন সবাই। আসন পেলেও যন্ত্রণা কম নয়। দুটি আসনের মধ্যে পা মেলার নূ্যনতম জায়গাটুকুও নেই। বয়স্ক, নারী এবং শিশু যাত্রীদের দুর্দশা আরও বেশি। সাধারণত এখন ৯০ শতাংশ বাসেই নারী যাত্রীদের উঠতে বাধা দেয় হেলপাররা। কারণ তারা বাসে উঠতে এবং নামতে সময় নেন বেশি। সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থাটিও নেই অনেক বাসে।
খিলক্ষেত থেকে নিয়মিত মতিঝিলে যাতায়াতকারী ব্যাংকার সজল আহমেদ জানান, সকাল ৯টায় অফিসে পেঁৗছার জন্য তিনি সকাল ৭টার মধ্যেই ঘর থেকে বের হন। কারণ রাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে হাতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় রেখেই বের হতে হয়। আগে সকাল ৭টার দিকে মোটামুটি বাসে ওঠার মতো পরিবেশ থাকত। এখন সে অবস্থাও নেই। সকাল ৭টায় রাস্তায় এসে খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি বাসে ওঠার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। তিনি বলেন, আগে খিলক্ষেত থেকে দুটি রুট দিয়ে মতিঝিলে যাওয়ার জন্য ছয়টি বাস সার্ভিসের কাউন্টার ছিল। এখন কাউন্টার আছে মাত্র দুটি। একটি বিআরটিসির, অন্যটি বেসরকারি ঢাকা পরিবহনের। ঢাকা পরিবহনের বাসে ভাড়া বিআরটিসির বাসের চেয়ে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেশি। এ বাসে সর্বনিম্ন ভাড়াই ১৫ টাকা। বাসগুলো বড় হলেও বেশিরভাগ বাসই পুরনো হয়ে গেছে। আসনগুলো বসার অনুপযোগী। বাসের ভেতর দাঁড়ানোর জন্য প্রশস্ত জায়গা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এসব বাস রাস্তার মাঝে দু'তিনবার করে অকেজো হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিআরটিসির নতুন বাসগুলো তুলনামূলক ভালো হলেও এ বাসগুলোতে অনেক ভিড় থাকে। মিরপুর থেকে নিয়মিত গুলিস্তানে যাতায়াতকারী নাসিম আহমেদ জানান, মিরপুর থেকে গুলিস্তান, মতিঝিল রুটের অধিকাংশ বাসই সিটিং সার্ভিস। এর মধ্যে বিআরটিসি এবং এনা পরিবহনের বাস তুলনামূলক ভালো। অন্যসব কোম্পানির বাস লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। প্রতিটি বাসেই নির্ধারিত আসনের চেয়ে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। সিটিংয়ের অজুহাতে এসব বাসে ভাড়া দিতে হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ। তারপরও অফিস সময়ে বাসে ওঠা যায় না। প্রতিটি সার্ভিসের বাসসংখ্যা কমে গেছে। কল্যাণপুর থেকে কারওয়ান বাজারে অফিস করা নুরুন্নবী জানান, এ রুটে বাস সংকট খুবই তীব্র। গাবতলী থেকে মতিঝিল হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত চলাচল করার ক্ষেত্রে ২২নং লোকাল বাসই বলতে গেলে একমাত্র ভরসা। অত্যন্ত নিম্নমানের এবং আকারে ছোট এসব বাসে যাওয়ারও পরিবেশ নেই। অধিকাংশ বাসের জানালার কাচ বিপজ্জনকভাবে ভাঙা, ইঞ্জিন কভার নেই, আসনের মধ্যে ভাঙা স্ক্রূ, লোহা_ এতে প্রতিদিন আহত হচ্ছেন সাধারণযাত্রীরা। এ ছাড়া ঠাসাঠাসি করে লোক তুলে এসব বাসকে বলা হচ্ছে ডাইরেক্ট সিটিং এবং আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া। ভয়াবহ নিম্নমানের এসব বাসে শ্যামলী থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত মাত্র এক কিলোমিটার পথ যেতেই নেওয়া হয় ১০ টাকা। সাভার থেকে অন্য যেসব বাসে ফার্মগেট, মতিঝিল, গুলিস্তান যাওয়া যায় সেগুলোর চিত্রও একই রকম। সুপার বাস নামে একটি বাসে উঠে দেখা যায়, বাসের দু'পাশের বডি ভেঙে ঝুলে পড়েছে। বাসের প্রায় প্রতিটি আসন ভাঙা। হেলপার জানাল, বাসের একটি হেডলাইটও নষ্ট প্রায় ১০ দিন ধরে। অথচ এ বাসটিতেই সর্বনিম্ন ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা। অত্যন্ত নিম্নমানের বাসে অস্বাভাবিক ভাড়া_ এই হচ্ছে গাবতলী থেকে মতিঝিল, গুলিস্তান প্রভৃতি রুটে চলাচলকারী বাসের বৈশিষ্ট্য। একই চিত্র মোহাম্মদপুর-মতিঝিল, মোহাম্মদপুর-বাড্ডা প্রভৃতি রুটে।
কুড়িল থেকে নিয়মিত শাহবাগে যাতায়াত করা উম্মে কুলসুম জানান, বাসের কাছে গেলে হেলপাররা অসভ্যভাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। একই দুর্ভোগ পোহাতে হয় শাহবাগ থেকে ফেরার সময়। এখানে বাসে ওঠার সময় বলেই দেওয়া হয়, বিশ্বরোডের যাত্রীরা উঠবেন না। জোর-জবরদস্তি করে উঠলেও প্রায়ই বিশ্বরোডে বাস থামানো হয় না। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে খিলক্ষেতে নামিয়ে দেওয়া হয় রাতের বেলাতেও।
বাস সংকট কেন : রাজধানীতে বাস সংকট কেন? এমন প্রশ্নে পরিবহন সংগঠন, সাধারণ মালিক, বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষের ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, বাস এবং যন্ত্রাংশের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সে তুলনায় যাত্রী ভাড়া বাড়ানো যাচ্ছে না। বাসের ব্যবসা এখন আর লাভজনক নয়। তিনি দাবি করেন, গত আড়াই বছরে ৪০টি কোম্পানি তাদের বাস সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। কাছাকাছি ধরনের মত দিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে অস্বাভাবিক যানজটের কারণে একেকটি বাসের ট্রিপসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে দফায় দফায় বাড়ছে জ্বালানির দাম। ফলে যাত্রীদের কাছ থেকে আগের চেয়ে বেশি ভাড়া নিয়েও লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া দুই-তিনপক্ষের চাঁদাবাজি ব্যাপক বেড়েছে। কিছু প্রভাবশালী লোক তাদের মতো করে বিভিন্ন রুট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ কারণে সাধারণ পরিবহন মালিকরা এ ব্যবসা থেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। কয়েকজন সাধারণ মালিক বলেন, একজন মালিককে তিনটি পক্ষকে চাঁদা দিতে হয়_ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ এবং সরকারি দলের নামে বিভিন্ন সংগঠনকে। পরিবহন মালিক সংগঠনের জন্য ট্রিপপ্রতি ৪০ টাকা চাঁদা নির্ধারিত থাকলেও চাঁদা নেওয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের জন্য ১০ টাকার নির্ধারিত চাঁদার পরিবর্তে দিতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এ ছাড়া পুলিশের চাঁদা দিন হিসাবে গাড়িপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এর বাইরে সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা আদায় করছে। সাধারণ মালিকরা জানান, জগন্নাথ কলেজ, টঙ্গী এবং গাজীপুরে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করছে ইচ্ছামতো। এ ছাড়া পরিবহন মালিক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা লাভজনক রুট বেছে নেওয়াসহ নানা সুবিধা নিয়ে নিচ্ছেন। কোম্পানির ব্যানারে বাস দিলে সেখান থেকেও কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডি পদাধিকারী মালিক সংগঠনের নেতারা দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জসহ নানা অজুহাতে সাধারণ মালিকদের কাছ থেকে আদায় করছেন। এসব মালিকের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে কিংবা পুলিশ অথবা সরকারি দলের ক্যাডারদের চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য হয়রানির শিকার হলেও কোম্পানি কিংবা মালিক সংগঠনের কেউ পাশে দাঁড়ান না।
সিএনজি অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব সাধারণের নাগালের বাইরে : রাজপথে হাতের কাছে দু'একটি সিএনজি অটোরিকশা থাকলেও ১৫০ থেকে ২০০ টাকার কমে এর চালকরা দামই হাঁকেন না। সিএনজি অটোরিকশার মিটারগুলো সচল নয়, অথবা ট্যাম্পারিং করা। কালেভদ্রে দু'একটা ট্যাক্সিক্যাব চোখে পড়লেও সেগুলোতেও ২০০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই। মিরপুর ১০নং গোলচত্বর থেকে ফার্মগেট আসতেও ভাড়া দিতে হয় ২০০ টাকা। অটোরিকশার অতিরিক্ত ভাড়া সম্পর্কে ঢাকা জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সমকালকে বলেন, এখন গ্যারেজ মালিকরা অবৈধভাবে দুই শিফটে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া দিচ্ছেন চালকদের কাছে। জমার টাকাও নিচ্ছেন বেশি। ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে, তাও আবার সাত-আট ঘণ্টার এক শিফটের জন্য। ফলে যানজটের মধ্যে এত কম সময়ে জমার টাকা তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন চালকরা। এ ছাড়া চালকদেরই জ্বালানি খরচ বহন করতে হয়। ফলে জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে গ্যারেজ মালিকদের কোনো সমস্যা না হলেও বিপদে পড়ছেন চালকরা।
অন্যদিকে ট্যাক্সিক্যাব সংকটের ব্যাপারে বারভিডা নেতা হামিদ শরীফ সমকালকে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নতুন ও উন্নতমানের ট্যাক্সিক্যাব নামছে না। পুরনো ট্যাক্সিক্যাবগুলোও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এর ফলে রাজপথে এখন ৫০০ ট্যাক্সিক্যাবও নেই। যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্য : নতুন দায়িত্ব নেওয়া যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিবহন খাতে বিদ্যমান অবস্থা জানার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করছেন। রাজধানীর গণপরিবহন খাতে বিপর্যয় ও নৈরাজ্যের ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি নজরে আছে। এ সমস্যা দূর করে সাধারণ নাগরিকদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.