প্রতিকারে চাই বিশেষ ব্যবস্থা-কিশোর অপরাধ by জিল্লুর রহমান রতন

কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির সাম্প্রতিক প্রবণতায় উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। ভিডিও গেমস নিয়ে কথা কাটাকাটির কারণে স্কুল সহপাঠীকে হত্যা করা থেকে শুরু করে সেমিস্টার ফি জোগাড় করতে বন্ধুকে খুন_ এসব খবর আমরা পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই দেখছি। এ ছাড়াও কিশোরদের মধ্যে মাদক সংক্রান্ত অপরাধ যেমন মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়া, অবৈধ অস্ত্র বহন ও ব্যবহার, গাড়ি চুরি, পকেটমার, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যাপ্রচেষ্টা ও বোমাবাজিসহ বিভিন্ন
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভবিষ্যতে কিশোর অপরাধ নতুন একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
কিশোর অপরাধী তাদেরকেই বলা হয় যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু এমন একটি অপরাধ সংঘটিত করেছে যেটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয়। বিভিন্ন দেশে আইনের মাধ্যমে কিশোর অপরাধের এ বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বয়সসীমা ১০ বছর হলেও জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ এটি ১২ বছর করার পক্ষে। আমাদের দেশে ২০০৪ সালে এ বয়সসীমা ৭ থেকে ৯ বছরে উন্নীত করা হয়েছে, যেটি জাতীয় শিশুনীতিতে আরও বাড়ানোর চেষ্টা প্রক্রিয়াধীন। সারাবিশ্বে কিশোর অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে যায় নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে। আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকলেও অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ (২০০৮) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশের বিভিন্ন কারাগারে ১৯৯০ সালে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪ জন, যা ২০০০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৭৪ জনে। বর্তমানে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করায় এ সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ২০৫-এ (ইউনিসেফ ২০০৯)। কিন্তু এসব পরিসংখ্যান আমাদের দেশের কিশোর অপরাধের শুধু আংশিক চিত্র বহন করে; কোনোভাবেই পুরোটা নয়।
বিভিন্ন দেশে কিশোর অপরাধকে শহুরে বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর ব্যাপ্তি শহর, গ্রামাঞ্চল ও আর্থসামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে সব জায়গায় বিস্তৃত। অপরাধ সংঘটনে বৈচিত্র্য থাকলেও বিষয়টি সর্বজনীন। আমাদের দেশের চিত্রও প্রায় একইরকম। কিশোর অপরাধকে এক সময় বখে যাওয়া ক্ষুদ্র উপদলীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপাদান যেমন জিনেটিক বা বংশগতি, ব্যক্তিত্বের ধরন, বেড়ে ওঠার পরিবেশ, অভিভাবকত্বের ধরন, পরিবার ও আর্থসামাজিক বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন, পুঁজিবাদী সভ্যতার সৃষ্ট ভোগসর্বস্ব সমাজ, নূ্যনতম সুবিধাবঞ্চিত কৈশোর, নৈতিক মূল্যবোধর অবক্ষয় অনেকাংশে দায়ী। দলগত অপরাধ ছাড়াও কিশোর অপরাধ এককভাবে ও ধ্বংসাত্মক পর্যায়েরও হতে পারে। বর্তমানে সমাজে শিশু-কিশোরদের সুস্থ বিনোদন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে বেশি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। সমাজ পরিবর্তনের এ ধারাটিও কিশোর অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর অপরাধীদের দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর এবং বেশিরভাগ ছেলে। কিন্তু বর্তমানে কিশোরীদের মাঝেও অপরাধপ্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিশোর অপরাধের কারণের বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, একবার অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলে তার আর ফেরার উপায় থাকে না। আবার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্র উপদলের সংস্রবে এসেও কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে বলে থাকেন, অপরাধপ্রবণতা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়। শিশু-কিশোরদের প্রতি সহিংসতা, নিচু মানের পারিবারিক সম্পর্ক, যেমন_ দাম্পত্য কলহ, ডিভোর্স ও পারিবারিক নির্যাতন তাদের অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়িয়ে তোলে। কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন_ আচরণগত সমস্যা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, অতিচঞ্চলতা, সহিংস আচরণ, সাধারণের তুলনায় কম বুদ্ধি, বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি প্রভৃতি কিশোর অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ জন্য কিশোর অপরাধীদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মনোসামাজিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ অবস্থা নিরূপণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিশোর অপরাধ সংঘটিত হলে আদালত থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য, সংশোধনাগারে পাঠানো কিংবা সতর্ক করে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক আসামির সঙ্গে রাখা বা তাদের মতো বিবেচনা করা যাবে না।
কিশোর অপরাধীদের ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের ভেতর পুনর্বার অপরাধ করার প্রবণতা হ্রাস করা। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের প্রচলিত আদালতের পরিবর্তে কিশোর অপরাধের জন্য বিশেষ কিশোর আদালতের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে কিশোরদের পর্যাপ্ত সহযোগিতার মাধ্যমে তার আচরণ সংশোধনের সুযোগ থাকতে হবে। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে তাকে শাস্তির পরিবর্তে সঠিক পথে বিকশিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করা। অনেক সময় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের পরিবর্তে শুধু অভিভাবকদের সতর্ক হয়ে মনোসামাজিক সহায়তা গ্রহণ, অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ, আবাসিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সে সঙ্গে মনেচিকিৎসক ও মনোবিদের সহায়তায় তাদের বিদ্যমান মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিশোরদের জন্য গাজীপুর ও যশোরে দুটি এবং কিশোরীদের জন্য গাজীপুরে একমাত্র কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। এসব কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর সেবার মান বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় লোকবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে জতিসংঘ নীতিমালা (রিয়াদ গাইডলাইন ১৯৮৮) অনুযায়ী যে কোনো সমাজে অপরাধ দমন নীতিমালায় কিশোরদের জন্য পৃথক ও বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের জাতীয় শিশুনীতিতেও বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। অপরাধের মামলায় যে শিশু হাঁটতে পারে না তাকে তার পিতার কোলে চড়ে আদালতে গিয়ে জামিন নেওয়ার ঘটনাও আমরা পত্রিকায় দেখেছি। এসব বিষয়ের আশু সুরাহা প্রয়োজন এবং কিশোর আদালতের কাজের পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। কিশোরদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা, খেলাধুলা, স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সে সঙ্গে তাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এতে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে সৃজনশীল কাজে বেশি উৎসাহী হবে। যুব উন্নয়ন কর্মসূচিকে আরও বেগবান করা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের সুস্থ পারিবারিক পরিবেশে, স্কুল ও কমিউনিটিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কিশোর অপরাধ প্রতিরাধে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণের সময় এখনই।

ডা. জিল্লুর রহমান রতন :সহকারী অধ্যাপক শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
mzrkhhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.