ডিজিটাল-মানবিকতা! by মিনার মাহমুদ

প্রচলিত কথায়, 'পাশবিক' শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে_ মানুষের কোনো হিংস্র অমানুষিক কর্মকাণ্ডে। উপমায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাক পশুরা। বিশাল জনগোষ্ঠীর এ ধারাবাহিকতায়, দৈনিক পত্রিকায় তাই শিরোনাম হয়_ 'তিন বছরের শিশু পাশবিকভাবে ধর্ষিত...।' খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, আমাদের জানা হিংস্রতম পশু সুন্দরবনের ১৮ বছর বয়সী কোনো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কি কখনও ধর্ষণ করেছে ৩ বছরের বাঘ ছানাকে? নাহ্। শুধু বাঘ কেন_ হায়েনা, চিতা,


সিংহ এমনকি সাগরের হিংস্রতম হাঙরের নেই, তিন বছর বয়সীকে_ এমন মানবিকভাবে ধর্ষণ করার কোনো পশু-ইতিহাস। নিরীহ প্রাণীদের প্রসঙ্গ প্রশ্নাতীত। এখানে তবু মানুষের যাবতীয় অমানবিক কর্মকাণ্ডের অযথা অপবাদ চালিত হয়ে আসছে পশুদের দিকে।
কারণ, বিষয়টা একতরফা। পশুদের প্রতিবাদের অধিকার আছে কি-না প্রশ্নও অবান্তর। যেহেতু তারা ভাষাহীন। তাই মানুষের খাদ্য থেকে শুরু করে, নিজস্ব কর্মকাণ্ডের সব মানবিক দায়িত্ব, ভাষাহীন হতভাগ্য পশুশ্রেণীর।
ধরা যাক_ পশুরা মানুষের পাশাপাশি একটি সভ্যতায় বসবাস করে। সবকিছুর মতো সংবাদপত্রও আছে তাদের। 'তিন বছরের শিশু পাশবিকভাবে ধর্ষিত...' খবরটির শিরোনাম তাহলে হতো_ 'তিন বছরের শিশু মানবিকভাবে ধর্ষিত'। আর এটিই বস্তুত সঠিক শিরোনাম।
নিজের স্বল্প জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায়, জাতির স্বপ্নের বেলুন 'ডিজিটাল' অর্থটা দেরিতে বোঝা গেল, নিজে আচমকা ঢাকা থেকে উত্তর ঢাকায় নিক্ষিপ্ত হয়ে। এক থেকে দুই, আবার টাকা থাকলে নাকি ৪ ঢাকা করার বাসনা ছিল_। সংখ্যার ক্রমশ উন্নয়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ!
পরিসংখ্যানে, হ্যাঁ কিংবা না_ এরপর 'নিরুত্তর'ও একটি দল আছে। নিজকে এ নিরুত্তর জনপদে নিরাপদ লাগে। শীতের সময় বলে বিদ্যুৎ থাকে এখন। থাকে টিভি চালু। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর ডিসকভারির মনোযোগী দর্শক। বিজ্ঞাপন বিরতিতে বিটিভি।
এখানেও বিজ্ঞাপন, কিন্তু দারুণ বিষয়_ নিরাপদে রাস্তা পারাপার। সুন্দর দেখানো হলো, কোলে শিশু নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার হঠাৎ বিপদ_। এরপর উপদেশ ক. ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার খ. ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হবে_। ওয়েট এ মিনিট! দৈনিক ঢাকা শহরে ফুটপাত আছে, কিন্তু পথচারীদের হাঁটার কোনো জায়গা নেই। ফুটপাতগুলো এখন হাজারো পণ্যের খোলা বাজার। এ বাস্তবতা এখন দেশের সবাই দেখেন। এমনকি বিজ্ঞাপনটির কপিরাইটার থেকে নির্মাতা সরকার_ সবাই জানেন। তবু 'ফুটপাত' নিয়ে মিথ্যা অলৌকিক একটি তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে জাতীয় টেলিভিশনে! সময়োপযোগী সুন্দর একটি বিজ্ঞাপনকে বাস্তবতা থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো ২০ বছর আগের, রূপকথার ঢাকায়। ধুত্তোরি বলে রিমোটে আবার ডিসকভারি। শিকার এবং শিকারি বিষয়ে। আফ্রিকার জঙ্গল প্রান্তের একটি খোলা জায়গা। একদল হরিণ চষে বেড়াচ্ছে মাঠের ঘাসে, ছোটগাছের ডগার পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে কান খাড়া হয় কোনো বিপদ সংকেতে। এসব দৈনন্দিন জীবন তাদের। প্রাণিকুলের খাদ্য পিরামিডে হরিণ একটি সহজ শিকার। অদূরে জঙ্গলের আড়াল থেকে শ্যেনদৃষ্টিতে একটি বাঘ। নিজের অপরিহার্য খাদ্য আর পাশাপাশি মাতৃদায়িত্বে বাঘটি। পেছনে শিকারে অক্ষম ক্ষুধার্ত দুটি ব্যাঘ্র শাবক। খিদেয় কাউমাউ শব্দ করছে। বাঘের শিকার চেষ্টায় গড়ে পনেরটির ভেতর একটি মাত্র সফল হয়। তাই শিকার পছন্দ করতে হয় যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে। বর্ণনাকারীর অসাধারণ বাক্য চলে অনবরত। ৫০ থেকে ২০০ কেজি ওজনের শিকার করে বাঘ সাধারণত। নিজে একবসায় ২০ থেকে ৩০ কেজি খেতে পারলেও খায় সাধারণত ১৫-১৮ কেজি। বাঘেরা সঞ্চয়মুখী। কিন্তু এখানের বিষয়টা অন্যরকম। শাবকরা ক্ষুধার্ত। আগে বাস্তবতা, পরে সঞ্চয়।
একটি হরিণ তাক করে বাঘটি। তারপর শুরু হয় দৌড় প্রতিযোগিতা। বাঘের জন্য খাদ্য, আর প্রাণ বাঁচানোর জন্য হরিণের দৌড়। রেসের ছবি স্লোমোশনে। জীবনটা পায়ের গতিতে নিয়ে, হরিণের বেঁচে থাকার লড়াই। লল্ফেম্ফর তীব্রতায় পেছনের দু'পা উড়তে থাকে শূন্যে। পেছনে বাঘের তাড়া। 'মানুষের ক্ষেত্রে এ খোলা মাঠের দৌড়ে খুনি থেকে প্রাণরক্ষার্থীরা সাধারণত জয়ী হয়। কিন্তু পশুদের বেলায় 'গতি'র সহজ অঙ্কই নির্ধারণ করে জয়-পরাজয়।' ধীরগতির সেই প্রামাণ্য চিত্রে দেখা যাচ্ছিল, খুব কাছ দিয়েই দলের অন্য হরিণরা যে যার মতো জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। এর যে কোনো একটা হাতের কাছেই_। কিন্তু শিকারি বাঘের লক্ষ্য স্থির। আবার বর্ণনাকারী_ 'একটির পেছনেই তার সব মনোযোগ। লক্ষ্য থেকে বাঘ নিজকে কখনও বিচ্যুত করে না।'
খাদ্য প্রয়োজনে হিংস্র হলেও, প্রাণী নৈতিকতায় বাঘের অবস্থান, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ওপরে। কেননা মানুষ বিচ্যুত হয়ে থাকে হরহামেশা।
মানুষের হিংস্রতা বোঝাতে নিরীহ পশুকে অনর্থক উপমায় টেনে, 'পাশবিক' বলা থেকে_ এর যথার্থ উপমা বরং আমরা মানুষরা। মানবিক।
minar.mahmood@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.