জাতিসংঘে টিপাইমুখ ইস্যু by সাজ্জাদ হায়দার

ভারত কর্তৃক নির্মিতব্য টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনে বাংলাদেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও বেশ কয়েক বছর আগেই ইস্যুটি UN Committee on Elimination of Racial Discrimination-এ আলোচিত হয়। কমিটির সপ্তম অধিবেশনে (১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ, ২০০৭) টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে বিরত থাকার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে মণিপুরের জনগণের স্বচ্ছ অভিমত গ্রহণেরও আহ্বান জানানো


হয়। সেই ১৯৯০ সালে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে মণিপুরের জনগণ তখনই প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। মণিপুরের ২০টিরও বেশি রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন মিলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে_নাগা পিপলস মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস, ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিল, নাগা ওম্যানস অ্যাসোসিয়েশন, নাগা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি।
আসাম ও মিজোরামেও অনুরূপ সংগঠন মিছিল, মিটিং ও অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যায়। শিলং আদিবাসী ফোরাম বলেছে, আদিবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেই ভারত সরকার বাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি আসামের পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট কমিটি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে পাঁচ দিনের অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মিত হলে শুধু ওই এলাকার জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয়ই হবে না, বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত ও জীবিকাহারা হবে। এসব মানুষের অধিকাংশ হতদরিদ্র আদিবাসী। এই বাঁধ নির্মিত হলে টিপাইমুখ এলাকার প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ৫৫টি গ্রাম চিরতরে হারিয়ে যাবে পানির তলে_এসব গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। এ ছাড়া বিশাল এলাকা অর্ধজলমগ্ন থাকবে। বরাক নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বিঘি্নত হওয়ায় মাছসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদসম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বরাক নদীর ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরাও জীবিকা হারাবে। তার ওপর রয়েছে ভূমিকম্পভীতি_এই এলাকা বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ। সাধারণত বিশাল কোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভৌগোলিক অঞ্চল এড়িয়ে করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৬ আগস্ট মণিপুর-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় রিখটার স্কেলে ৬.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর ভবিষ্যতে কোনো ধরনের ভূমিকম্প হলে মানুষ্যসৃষ্ট সুনামির কবলে পড়বে মণিপুর, মিজোরাম আর আসামের মানুষ। অন্যদিকে এই বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে খরা মৌসুমে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাবে, পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাবে। সুরমা-কুশিয়ারার পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল হাওরগুলো শুকিয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে মাছসহ অন্যান্য প্রাণিসম্পদ। ধ্বংস হবে কৃষি খাত, কর্মহীন হবে হাজার হাজার জেলে ও কৃষক। বিরানভূমিতে পরিণত হবে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকা।
গত অক্টোবরে বাঁধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মণিপুর সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করলে আসাম, মণিপুর এমনকি মিজোরামের জনগণের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শুধু ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য এই বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় ও ঝুঁকি ওই এলাকার মানুষ মেনে নিতে পারেনি। ইতিমধ্যে মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সায়েন্স বিভাগ টিপাইমুখ বাঁধের পরিবর্তে micro-hydel projects-এর মাধ্যমে সমপরিমাণ বিদ্যুৎপ্রাপ্তির প্রস্তাব দেয়। এ প্রকল্পের জন্য তারা বরাক নদীর উভয় তীরে প্রাথমিকভাবে ১৩০টি এলাকা চিহ্নিত করেছে। এ পদ্ধতি গৃহীত হলে জীববৈচিত্র্য কিংবা মানুষের বাস্তুচ্যুতির সম্ভাবনা নেই_উপরন্তু ওই এলাকার জনগণের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ প্রস্তাবের ব্যাপারে কেন্দ্র কিংবা মণিপুর সরকার কোনো সাড়া দেয়নি; বরং তারা অনেকটা চুপিসারে বাঁধ নির্মাণের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় এক হাজার কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয়ে নির্মিতব্য এই প্রকল্পের অংশীদার হলো মণিপুর সরকার, Satluj Jal Vidyut Nigam (SJVN) Limited I National Hydroelectric Power Corporation (NHPC) Limited. ৩৯০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬২.৮ মিটার উচ্চতার এই বাঁধ নির্মাণে সময় লাগবে সাত বছর তিন মাস। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ ও লভ্যাংশ তুলে নেবে। এ কারণে পরিবেশবাদীরা বলছেন, ওই বাঁধ নির্মাণের পেছনে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে বেশি কাজ করেছে বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ।
এদিকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চুক্তির সংবাদ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশের প্রায় পাঁচ দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি দায়সারা বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ নভেম্বর ২০১১ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে তাঁর শক্ত অবস্থান তুলে ধরেন এবং অবিলম্বে একজন বিশেষ দূত ভারতে প্রেরণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে_শুধু সরকার নয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ ইস্যুটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের সুযোগ ক্ষতির সম্মুখীন যেকোনো বাংলাদেশিরই রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক এখন বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কাছে বিচারপ্রার্থী হতে পারে। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও করা যেতে পারে। সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত যেকোনো বাংলাদেশি এ মামলা করতে পারেন। এ ব্যাপারে নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মণিপুরের আদিবাসীরা আমাদের পথ দেখিয়েছেন।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.