৩০ কোটি টাকার বাজেট পরিকল্পনাকারীরা চিহ্নিত

রাজধানীতে গত রোববারের সহিংস ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। রিমান্ডে থাকা আসামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ মূল পরিকল্পনাকারীদের কয়েক-জনকে শনাক্ত করেছে। ঢাকা অচল করে সরকার পতনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৩০ কোটি টাকার বাজেট করা হয়েছিল। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে নেপালে পরিকল্পনাকারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকেই চূড়ান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার নামে কীভাবে
রাজধানীতে অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। গ্রেফতার হওয়া একজন যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপির এক নেতা পরিকল্পনাকারীদের টাকার জোগান দেন। পুলিশ, ডিবি ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। কারা অর্থের জোগান দিয়েছেন আমরা এরই মধ্যে তাদের নাম জানতে পেরেছি।
অন্যদিকে গতকাল ডিএমপি সদর দফতরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের এক সভায় ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। রোববারের ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দফতরে ন্যস্ত হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি (দক্ষিণ) মনিরুল ইসলাম সমকালকে জানান, রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, রাজধানীতে বড় ধরনের
নাশকতা সৃষ্টির জন্যই লোকজন জড়ো করা হয়েছিল। নাশকতাকারীদের পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার নামে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেবে। সেখান থেকে সরকার পতনের ডাক দিয়ে প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের আশপাশে অবস্থান নিয়ে ঢাকা অচল করে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, হামলার পরিকল্পনাকারী, অর্থের জোগানদাতা, হামলা বাস্তবায়নে যারা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
রিমান্ডে আসামিদের দেওয়া তথ্য সম্পর্কে ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, রিমান্ডে আসামিরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মামলার তদন্তে অনেক সহায়ক হবে। তিনি বলেন, আসামিদের তথ্যমতে ওই ঘটনায় ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। রিমান্ডে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, তদন্তে যাদের নামই আসবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এখানে কোনো পদ-পদবি দেখা হবে না।
একটি নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্র সমকালকে জানায়, পরিকল্পনাকারীদের কয়েকজন চলতি মাসের প্রথমদিকে নেপাল যান। সেখানে তারা নাশকতার ছক চূড়ান্ত করে দেশে ফেরেন। রোববার একটি গোয়েন্দা সংস্থা পরিকল্পনার বিষয়টি টের পায়। এরপর তারা ব্যাপক নজরদারি শুরু করে। আবার গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টি টের পান পরিকল্পনাকারীরা। এরপর তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লুকিয়ে কীভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন_ এ ফন্দি আঁটতে গুলশানে একটি বারে বসেন। সেখানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায় ওই বারেও অভিযান চালায়। তবে আগেই সটকে পড়েন পরিকল্পনাকারীরা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে কারা পরে তদারক করেছেন, তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। কারা মোবাইল ফোনে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাদেরও নাম পাওয়া গেছে। কাদের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করে ঢাকায় ১ লাখ মানুষ জড়ো করার পরিকল্পনা ছিল, তাদের সবাইকে এরই মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। মামলার আসামিদের ধরতে নগরী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দারা।
ডিএমপি ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রিমান্ডে আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের যেসব নেতার নাম এসেছে তারা হলেন_ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরব, যুবদল উত্তরের সভাপতি হাসান মামুন, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলীমসহ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-সভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক পদধারী আরও পাঁচজন এবং যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাসাসের মহানগর কমিটির শীর্ষ কয়েক নেতা।
রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাংচুর, অগি্নসংযোগ, পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় শাহবাগ, রমনা, পল্টন, মতিঝিল, তেজগাঁও ও বাড্ডা থানায় পুলিশ বাদী হয়ে ১১টি মামলা করেছে। এসব মামলায় পুলিশ মোট ১১৯ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
পল্টন থানায় গ্রেফতারকৃত ঢাকার দোহারের বাসিন্দা রহিম খন্দকার, আবুল হাসান ও উজ্জ্বল জানান, দোহারের এক বিএনপি নেতার নির্দেশে তারা রোববার সকালে ৪০ সদস্যের একটি টিম নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় পাঠানোর সময় বলা হয়েছিল, খাওয়ার ও হাত খরচের টাকা দেওয়া হবে। তাদের দায়িত্ব বিএনপি নেতাদের নির্দেশে রাস্তায় বসে থাকা। কিন্তু রোববার খুব ভোরে পিকআপ ভ্যানে করে গুলিস্তানের মুক্তাঙ্গন এলাকা থেকে পুলিশ তাদের আটক করে। পুলিশ রহিম খন্দকারের কাছ থেকে একটি ৪০ সদস্যের তালিকা উদ্ধার করে।
একইভাবে রাজধানীর শাহবাগ থানায় রিমান্ডে থাকা ২৬ আসামির মধ্যে অধিকাংশের বাড়ি সাভার এলাকায়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর তাদের ৫০-৬০ জনের একটি টিম রোববার ভোরে গাড়ি ভাড়া করে ঢাকায় পাঠান। তারা শাহবাগ এলাকায় ভাংচুর করার সময় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।
পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি কৃষ্ণপদ রায় সমকালকে বলেন, রমনা থানায় করা দুটি মামলায় ৪২ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৭ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। তাদের সাভার ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ভাড়া করে আনা হয়।
মঙ্গলবার রিমান্ডের প্রথম দিন শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রিমান্ডে আসামিদের দেওয়া তথ্যমতে রোববারের ঘটনায় আরও বেশ ক'জন বিএনপি নেতার নাম বেরিয়ে এসেছে।
তিনি আরও জানান, ঘটনার সূত্রপাত করেছিল জামায়াত। কাকরাইলে মিছিল করার মাধ্যমে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে; কিন্তু নগরীর বিভিন্ন স্থানে যখন বিএনপি কর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে তখনই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সরে পড়ে। আর এ কারণেই পরে মাঠে জামায়াতকে পাওয়া যায়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, ঘটনার সময় কর্মীরা এসব নেতার কাছে নির্দেশনা চেয়েছিল। নির্দেশ অনুযায়ী তারা মাঠে এসব সংঘর্ষ, ভাংচুর, অগি্নসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.