বেরিয়ে পড়ূন ঘুরতে

লছে ভ্রমণের মৌসুম। তাই ভ্রমণপিয়াসীদের এখনই সময় ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ার। ভ্রমণের সুবিধার্থে বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বত আর সমুদ্র সৈকতের নানা জানা-অজানা কথা নিয়ে লিখেছেন জান্নাতুল এ্যানিআমাদের দেশের প্রাকৃতিক সবুজ নিসর্গ, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত, বনভূমিসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা এ দেশের মানুষসহ বিশ্বের ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে ষড়ঋতুর এ দেশ বাংলাদেশকেই একটু


ভালোভাবে ঘুরে দেখুন। প্রথমেই ঠিক করে নিন কোন জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাবেন। যেহেতু শীতকাল, তাই পাহাড় বা সমুদ্রকে বেছে নিতে পারেন। বাংলাদেশের পাহাড়িকন্যা বান্দরবান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবারিত সবুজের সমারোহ এবং মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা যার আছে তিনি সহজেই ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে যেসব পাহাড়ের দেখা মিলবে_
নীলগিরি : বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বদিকে লামা উপজেলার অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২০০ ফুট ওপরে নীলগিরির অবস্থান। একে বাংলাদেশের দার্জিলিং হিসেবে অবহিত করা যায়। এখানে পাহাড় আর মেঘের মিতালি চলে দিন-রাত। নীলগিরি যেতে হলে আগে থেকে ল্যান্ডত্রুক্রজার জিপ ভাড়া করতে হবে। সময় লাগবে আসা-যাওয়ায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা। ভাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত ছোট জিপ (৫ সিট) ২ হাজার ৩০০ টাকা এবং বড় জিপ (৮ সিট) ২ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু এখানে ড্রাইভাররা আপনার কাছে আরও বেশি ভাড়া চাইতে পারে।
নীলাচল : নীলাচল বান্দরবান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে ১ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি পর্বত শীর্ষ। যেখান থেকে নীল আকাশ যেন তার নীল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে ভূমির সবুজ জমিনে।
চিম্বুক : বান্দরবান শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিলনছড়ি ও শৈলপ্রপাত ফেলে চিম্বুক যেতে হয়। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় রেস্টুরেন্ট এবং একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে।
মেঘলা : নাম মেঘলা হলেও মেঘের সঙ্গে মেঘলা পর্যটন স্পটের কোনো সম্পর্ক নেই। বান্দরবান জেলা শহরে প্রবেশের ৭ কিলোমিটার আগে মেঘলা অবস্থিত। এটি সুন্দর কিছু উঁচু-নিচু পাহাড়বেষ্টিত একটি লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মেঘলার পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বান্দরবান পর্যটন হোটেলটি।
শৈলপ্রপাত ও মিলনছড়ি : বান্দরবান শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে চিম্বুক বা নীলগিরি যাওয়ার পথে শৈলপ্রপাত দেখা যাবে। মিলনছড়ি বান্দরবান শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে শৈলপ্রপাত বা চিম্বুক যাওয়ার পথে পড়ে। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে।
স্বর্ণমন্দির : বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই বৌদ্ধ ধাতু জাদীকে স্বর্ণমন্দির নামকরণ করা হয়। এটি বান্দরবান শহর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে বালাঘাট নামক এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।
কেওক্রাডং : কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা ৩ হাজার ১৭২ ফুট। এর অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে বাংলাদেশের আরাকানি পার্বত্য অঞ্চলে। কেওক্রাডং পাহাড়ে বগা লেকের অবস্থান। বান্দরবান শহর থেকে যার দূরত্ব ৫৬ মাইল।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে আপনি ২/৩টি রুট ব্যবহার করতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেন বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম, তারপর চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের এসি ট্রেন ৩৬৫-৪৮০ এবং নন-এসি ১৫০-১৬৫ টাকা। এসি বাস ৫৮০-৭৯০ এবং নন-এসি বাস ২০০-২৫০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে চাইলে বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে নন-এসি বাস আছে, যা ৩০ মিনিট পরপর বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৭০ টাকা।
ঢাকা থেকে বান্দরবান পর্যন্ত ডাইরেক্ট গাড়ি যেতে চাইলে ভাড়া গুনতে হবে ৩৫০ টাকা।
রাঙামাটি : পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়ানোর উল্লেখযোগ্য স্পটের মধ্যে রাঙামাটি অন্যতম। নিসর্গের উদার সম্ভারে গরীয়সী রাঙামাটিতে পাহাড়, টিলা আর অরণ্যের বিশাল বিস্তার। এখানে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে। রাজবাড়ি রানী দয়াময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজাতীয় জাদুঘর প্রভৃতি দেখার মতো। এখানে কর্ণফুলী নদীতে নৌ-বিহার হয়ে অপর দুর্গম পাহাড়ে যাওয়া যায়।
শুভলং : রাঙামাটি থেকে শুভলং বেশি দূরে নয়। স্পিড বোট দিয়ে এখানে যেতে হয়। সময় লাগে ৪০ মিনিট। পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত শুভলংয়ে দেখবেন অরণ্য আর ঝরনা।
বরকল : রাঙামাটি থেকে লঞ্চে এখানে যেতে হবে। এখানে পাহাড় আর অরণ্য আছে। এখানের অরণ্যে হাতি, ভাল্লুক, শূকর, হরিণ রয়েছে। এখানে বসে লুসাই পাহাড় দেখা যায়।
রামগড় : ফেনী থেকে এখানে যাওয়া খুবই সহজ। বাসে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। রামগড়ের আশপাশে পাহাড় আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে নিতে পারেন। এখানে ফেনী নদীর ওপারে ত্রিপুরা রাজ্য।
রাজস্থলি : চন্দ্রঘোনা থেকে মাত্র ২ ঘণ্টায় রাজস্থলি যাওয়া যায়। এখানে আছে পাহাড়, অরণ্য আর বিল। শীতের সময় বিলে অসংখ্য অতিথি পাখি আসে।
কাপ্তাই : চট্টগ্রাম থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই। দু'কূলে পাহাড়-অরণ্য দেখে রাঙামাটি থেকে লঞ্চে কাপ্তাই আসা যায়। কাপ্তাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ কাপ্তাই লেক। ২ মাইল দূরে কর্ণফুলী নদীর ওপারে রয়েছে চিৎমুরং বৌদ্ধ মন্দির।
শীলছড়ি : কাপ্তাইয়ের কাছেই শীলছড়ি। এখানে আছে ঝরনা আর বনাঞ্চল। পাহাড়ের গায়ে চোখ রাখলে দেখা যাবে বানর কিংবা অন্যান্য কোনো প্রাণী।
খাগড়াছড়ি : পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক জেলা শহর এই খাগড়াছড়ি। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে এখানে যাওয়া যায়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে খাগড়াছড়ি শহর। বেশি দূরে নয় দীঘিনালা ও পানছড়ি। খাগড়াছড়ির সর্বত্রই পাহাড়ের পর পাহাড়। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। সকাল ৭টার বাসে উঠলে বিকেল ৪টায় খাগড়াছড়ি পেঁৗছে যাবেন। এ বাস রামগড় হয়ে যাবে।
এবার আসি সমুদ্রপথের কথায়
কক্সবাজার : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের তীরে সৈকত শহর কক্সবাজার। মাইলের পর মাইল বালুকাময় সৈকত, দুষ্প্রাপ্য ঝিনুক, বৈচিত্র্যময় প্যাগোডা, উপজাতিদের অভিনব জীবনযাত্রায় পূর্ণ। কক্সবাজার যেতে হলে আপনাকে চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার অল্প সময়ে বিমানে যেতে পারেন। এ ছাড়া সরাসরি চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যাওয়ার চমৎকার সব বাস রয়েছে। আপনি চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নেমে সেখানে বেড়িয়ে তারপর কক্সবাজার যেতে পারেন। এটা করতে হলে আপনাকে প্রথমে চট্টগ্রামে যাওয়ার বাসে উঠতে হবে। তারপর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বাসে উঠবেন। কক্সবাজার রাতযাপনে অতিরিক্ত ভাড়ায় বিলাসী হোটেল রয়েছে। কম ভাড়ার হোটেলও রয়েছে। এখানে পর্যটন করপোরেশনের কয়েকটি খুব ভালো হোটেল আছে। সেগুলোর মধ্যে হোটেল শৈবাল, প্রবাল উল্লেখযোগ্য।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত : চট্টগ্রাম থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। ১ ঘণ্টায় ওখানে যাওয়া যাবে। যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে সি-পোর্ট, এয়ারপোর্ট দেখতে পাবেন। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে টেম্পোতে যেতে পারেন। টেম্পো ছাড়ে নিউমার্কেট থেকে। পতেঙ্গার পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও নৌবাহিনীর কার্যালয়।
সেন্টমার্টিন : বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অসংখ্য প্রবাল মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। পুরো দ্বীপ ঘুরলে মনে হবে নারিকেল বাগান এটি। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাত্রাপথটি মন্দ নয়। গাংচিল আর ডলফিন দেখতে দেখতে এ ২ ঘণ্টার ভ্রমণটি আপনার মুহূর্তেই কেটে যাবে। দ্বীপটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থে কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকজুড়ে রয়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপের শেষ মাথায় সরু লেজের মতো আরেকটি অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ রয়েছে, যার নাম ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ারের সময় পানি এসে এটিকে মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলেই এর নাম ছেঁড়াদ্বীপ। পর্যটন মৌসুমে সেন্টমার্টিনে স্কুবা ডাইভও দেওয়া যায়। ঘণ্টাপ্রতি খরচ পড়বে ২,০০০-২,৫০০ টাকা। সীমানা পেরিয়ে, ব্লু মেরিন, অবকাশ, শৈবাল, পর্যটন মোটেলসহ আরও কয়েকটি ভালো হোটেল রয়েছে। রুমপ্রতি ভাড়া ৫৫০-১,৫০০ টাকা।
যাতায়াত : ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে বাসে করে টেকনাফ যাওয়া যাবে। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদে এর বাস পাওয়া যায়। ঈগল, মডার্ণ লাইন, এস. আলম, শ্যামলী ইত্যাদি বাস রয়েছে। এসি বাস ১,১০০ টাকা, নন-এসি ৫৬০ টকা। ১০-১৩ ঘণ্টা লাগে পেঁৗছতে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে নিয়মিত বাস পাওয়া যায় টেকনাফের উদ্দেশে। এ ছাড়া মাইক্রোবাস ভাড়া করেও টেকনাফ যাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে ১,৫০০-২,০০০ টাকা। টেকনাফ থেকে সি-ট্রাকে (ভাড়া ৪৫০-৫৫০ টাকা) সেন্টমার্টিন যেতে হবে। এ ছাড়া ট্রলার ভাড়া করেও যেতে পারেন। সেন্টমার্টিনের মূল অংশ থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটে ছেঁড়াদ্বীপ আসা যায়। ৩০ মিনিট সময় লাগবে ট্রলারে আসতে।
কুয়াকাটা : কুয়াকাটা দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। কুয়াকাটায় সূর্যোদয় দেখতে ঝাউবনে যাওয়াই ভালো। সকালে হেঁটে হেঁটে ঝাউবনে যেতে সময় লাগবে ২০ মিনিট। আর ভ্যানে গেলে সময় লাগবে ১০ মিনিট।
কীভাবে যাবেন কুয়াকাটা : ঢাকা থেকে সড়কপথে দ্রুতি পরিবহন, সাকুরা পরিবহনে কুয়াকাটায় যেতে পারবেন। ভাড়া ৫০০-৫৫০ টকা। ১২/১৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। খুলনা থেকে কুয়াকাটা যেতে সকাল ৭টায় একটি বিআরটিসি বাস ছাড়ে। সময় লাগে ৭/৮ ঘণ্টা। বরিশাল হয়ে যেতে চাইলে পটুয়াখালী গিয়ে রেন্ট-এ-কারে বা পটুয়াখালী-কুয়াকাটা রুটের বাসে চড়ে কুয়াকাটা পেঁৗছতে পারেন।
থাকার ব্যবস্থা : কুয়াকাটায় আছে দুটি ডাকবাংলো এবং সাগরকন্যা পর্যটন হলিডে হোমস, নীলাঞ্জনা, বি-ভিউ, গোল্ডেন প্যালেস, বিচ-ভেলীসহ অনেক হোটেল ও মোটেল।

ছবি :হাসিবা আলী বর্না, সাইয়ান নাহিয়ান, জয়ন্ত দেবনাথ

No comments

Powered by Blogger.