সূর্যসেনের শহর ক্রিকেট প্রেরণারও শহর by নোমান মোহাম্মদ,

ই সময়টাতেও বাংলাদেশ ছিল নতজানু। ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট এক ভূ-খণ্ড। নিপীড়ন-নির্যাতনে দশ দিকে তখন হতাশার নিকষ আঁধার। গত শতাব্দীর ত্রিশের শতকের শুরুর দিকের সময়টায় এই ছোট্ট দেশটির জন্য আলোর স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে এই চট্টগ্রাম থেকে। মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বের সেই বিপ্লবের চকমকি পাথরে ধড়ফড়িয়ে যেন জেগে ওঠে বাংলাদেশ।কালের খেয়ায় ভেসে এরপর এই চট্টগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা এসেছে বহুবার। বহু ভাবে। অন্য সব ব্যাপার যেমন-তেমন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য এই শহর বরাবরই পয়মন্ত।


সাফল্যের রঙিন ঘুড়ি যে বন্দরনগরীর আকাশে উড়ে বেড়িয়েছে অনেকবার। আরেকবার, এই কোণঠাসা অবস্থায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর লড়াইয়ের সেই উজ্জীবনী সুধা এই শহর থেকেই নিচ্ছে বাংলাদেশ।
আগেই বলা, প্রেরণার সেই শেকড় প্রোথিত ইতিহাসে। কারণ চট্টগ্রাম যে দুই হাতে ভরে দিয়েছে বাংলাদেশকে। সর্বশেষ বিশ্বকাপটাই দেখুন না! ৫৮-লজ্জার পর বিধ্বস্ত এক দল এসেছিল এই সমুদ্রের কোলঘেঁষা শহরে। কী বিস্ময়কর! সেই দলটিই কিনা পরের ম্যাচে হারিয়ে দিল ইংল্যান্ডকে! এর পরের খেলায় নেদারল্যান্ডসকেও। কক্ষচ্যুত বাংলাদেশ ক্রিকেটের ট্রেন লাইনে ফেরে এই চট্টগ্রামেই।
এ তো শেষেরটা। শুরুটাও কম কী! এখানেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পেয়েছিল পরম আরাধ্য, পরম আকাঙ্ক্ষিত প্রথম টেস্ট জয়। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের সেই যুগ পেরিয়ে ক্রিকেট চলে এল সাগরিকায় জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। এখানে তো আরো দুরন্ত পারফরম্যান্স। ১৩টি ওয়ানডে খেলে জিতেছে ৬টিতেই।
দল হিসেবে যেমন প্রেরণার টুকিটাকি ছড়ানো রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, ক্রিকেটার হিসেবেও অনেকের জন্য তাই। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম এই স্টেডিয়ামেই পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ভারতের বিপক্ষে ১১৪ বলে ১০১ রানের সেই ইনিংস দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন বোদ্ধারা। এখানে ৫ টেস্টে ৫১৩ রান করেছেন ৫১.৩ গড়ে। ওয়ানডেতে অবশ্য ততটা হাসেনি অধিনায়কের ব্যাট। ৮ ম্যাচে ১০৩ রান করেছেন মোটে ২৫.৭৫ গড়ে। নেই কোনো হাফ সেঞ্চুরিও। ওয়ানডেতে ভালো করার জন্য নিশ্চয়ই মুখিয়ে থাকবেন মুশফিক।
চট্টগ্রামে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি মনেপ্রাণে চাইছেন শফিউল ইসলাম। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মাহমুদ উল্লাহর সঙ্গী হয়ে বাংলাদেশকে অসম্ভব এক জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। কাল প্র্যাকটিসে নামার আগে হাসতে হাসতে স্মৃতিচারণায় মেতে উঠলেন শফিউল, 'চট্টগ্রামে এসেই ওই ম্যাচটির কথা ভাবছি। ভাবছি সে রকম একটা ম্যাচ যদি কালও (আজ) খেলতে পারি।' ব্যাট না বল হাতে_প্রশ্নের সহাস্য উত্তর, 'দুটোই'।
সেবার চট্টগ্রামে শেষবেলার নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন মাহমুদ-শফিউল। তবে ১০০ বলে ৬০ রান করে জয়ের ভিত্তিটা কিন্তু ইমরুল কায়েসের গড়ে দেওয়া। ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছেন এই ওপেনার। নেদারল্যান্ডসকে হারানো পরের ম্যাচে অপরাজিত ৭৩ রান করে আবারও ম্যাচসেরা। 'আমার কাছে চট্টগ্রাম তাই এখন বিশেষ কিছু। তবে সত্যি বলছি, এর আগ পর্যন্ত এখানে খেলতে আসলেই ভয় পেতাম'_কেন ইমরুলের এমন কথা? চট্টগ্রামে তাঁর খেলা প্রথম তিন ওয়ানডেতে ১২, ১৭ ও ২ রান, প্রথম তিন টেস্টে ৬ ও ৫, ২৩ ও ১, ৪ ও ২৩ রানের ইনিংসের কারণে। চট্টগ্রাম জুজু তাই ইমরুলের জন্য স্বাভাবিক। বিশ্বকাপের দুই ম্যাচের পর এখন আবার এই শহরই অনন্ত প্রেরণার উৎস, 'জিম্বাবুয়ে সফর থেকেই রান পাচ্ছি না। এবার চট্টগ্রামে এসেছি, নিশ্চয়ই সেই খারাপ সময় কেটে যাবে।'
মোহাম্মদ আশরাফুলের দুঃস্বপ্নের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে আছেন অনেক দিন। অনুপ্রেরণার জন্য ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে ধ্রুপদী ১৫৮ রানের কথা মনে করিয়ে দিতেই নিজে পাড়লেন আরেকটি ইনিংসের কথা, 'শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৬ রানের ইনিংসটির কথা বললেন না?' ঠিক তো। এই সাগরিকায় প্রথম ম্যাচেই ছবির মতো ওই ইনিংস খেলেছিলেন আশরাফুল। এরপর বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হয়েছেন ক্রমে। এখানে পরের ১২টি টেস্ট ইনিংসের মধ্যে একটি হাফ সেঞ্চুরিও নেই। ৯ ইনিংসে আউট হয়েছেন দুই অঙ্কে যাওয়ার আগে। ওয়ানডেতেও বিস্ময়কর সাযুজ্য। এখানে প্রথম ইনিংসে ৬৪ করার পর খেলেছেন আরো ৬ ম্যাচ। কোনোটিতেই দুই অঙ্কে যেতে পারেননি! চলতি সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে ২ ও ০ করার পর আজ একাদশে আশরাফুল থাকবেন কি না, নিশ্চিত নয়। থাকলে ভিন্ন কিছুর প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন তিনি, 'দুই ম্যাচে অমন খেলে নিজের ওপরই খানিকটা চাপ নিয়ে নিয়েছি। চট্টগ্রামে সুযোগ পেলে চেষ্টা করব, বড় ইনিংস খেলে সেটি কাটিয়ে ওঠার।'
চট্টগ্রামকে প্রেরণা হিসেবে নেওয়ার উপলক্ষ আছে আরো অনেকের জন্য। অলক কাপালি যেমন এই শহরেই খেলেছিলেন তাঁর ৮৫ রানের সেই সিগনেচার নক। সাকিব আল হাসান যেমন ব্যাটে-বলে একাই প্রায় টেস্টে হারিয়ে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে। এখানে সমুদ্র ছুঁয়ে আসা মিঠে বাতাসে উদ্দীপনার রেণু ভেসে বেড়াচ্ছে নাঈম ইসলামের জন্যও। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য অপরাজিত সেই ৭৩ রানের ইনিংসে বাংলাদেশকে এক উইকেটে জেতানো ম্যাচটি কি ভোলা যায়! 'শুধু আমার নয়, মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সেটি ছিল বিশেষ এক ম্যাচ। অমন হেরে যাওয়া অবস্থা থেকে ম্যাচ জেতার যে আত্মবিশ্বাস, সেটি কাজে লেগেছে পরবর্তী সময়ে। হেরে যাওয়ার আগে আমরা আর হারি না'_স্মৃতির পুকুরে ডুব দিয়ে বলছিলেন নাঈম। সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার আগে সেটি যে মেনে নিতে নারাজ তাঁরা, অনুচ্চারে সেটিও কি বললেন না?
সিরিজের নিষ্পত্তি আগে হয়ে গেলেও আজকের ম্যাচ তাই বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কিছু। চট্টগ্রামের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে আজ মাঠে নামবেন ১১ ক্রিকেট-যোদ্ধা। এখন দেখার বিষয়, এদের মধ্যে কে হবেন মাস্টারদা! সূর্যসেনের বিপ্লবে স্বাধীনতা আসেনি, তবে তা হয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা। আজকের পারফরম্যান্সে তেমনি সিরিজ জেতা যাবে না, কিন্তু নতজানু এক দলকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সম্ভব টেস্ট সিরিজের আগে আত্মবিশ্বাসে জ্বালানি দেওয়া। এ কারণেই আজ চট্টগ্রামে ক্রিকেটের পোশাকে মাস্টারদাকে খুঁজবে বাংলাদেশ!

No comments

Powered by Blogger.