শেয়ারবাজারে ৩২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন : অনশনকারীদের সরিয়ে দিল পুলিশ ৩ খাতে কর কমানোর এসআরও

মরণ অনশন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে পুলিশি বাধার মুখে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চত্বরে দাঁড়াতেই পারেননি বিনিয়োগকারীরা। গ্রেফতার এড়াতে এবং জীবনের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন। শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে দেশব্যাপী হরতালসহ কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে বলে বিনিয়োগকারীরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।


এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গতকাল ৩২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। লেনদেন হয়েছে মাত্র ২২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর আগে ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সর্বনিম্ন ২১৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। লেনদেনে বড় ধরনের ধস নামায় বিশ্লেষকরা বাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারল্য সঙ্কট কাটাতে না পারলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করছেন।
অপরদিকে শেয়ারবাজারে অব্যাহত ধসের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৬ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেছে সরকার। এছাড়া সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা বহাল, মিউচুয়াল ফান্ডের অর্জিত আয়কে করমুক্ত এবং ব্রোকারেজ হাউজগুলোর লেনদেনের ওপর আরোপিত কর ০.১০ শতাংশ থেকে ০.০৫ শতাংশে কমিয়ে আনার বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। গতকাল এসইসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান এনবিআরের প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে বলেন, আগেই এনবিআরের সঙ্গে এসইসির বৈঠকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সোমবার সকালেই এনবিআরের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কালোটাকা বিনিয়োগ নিয়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে নতুন কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আগেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
পুলিশের বাধার মুখে বিনিয়োগকারীরা : বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের ব্যানারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করলেও গতকাল সকাল ৯টার দিকে তাদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। ডিএসই চত্বর থেকে সরিয়ে দিতে পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। এ সময় বিনিয়োগকারীরা সরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ঐক্যপরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরীসহ ১০ থেকে ১২ জনকে পুলিশ আটক করে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মাইক, ব্যানার, ফেস্টুন ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। ডিএসই চত্বরে কোনো অবস্থান নেয়া যাবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়। একজন বিনিয়োগকারী জানান, পুলিশের একজন কর্তাব্যক্তি বলেন, অন্য কোথাও গিয়ে পারলে মরেন; কিন্তু ডিএসইর সামনে কোনো অবস্থান নিতে পারবেন না। পুলিশ আটককৃতদের ছেড়ে দিলেও মিজানুর রশীদ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে বেলা ৩টার দিকে তাকেও ছেড়ে দেয়া হয়।
বিনিয়োগকারীদের ডিএসই চত্বরে রাতভর অবস্থান : সাধারণ বিনিয়োগকারীরা রোববার সারারাত ডিএসই চত্বরে অবস্থান করেছেন। কয়েকশ’ বিনিয়োগকারী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাদের অবস্থানের কারণে সারারাত ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একপাশে যানচলাচল বন্ধ ছিল। কর্মসূচিতে অংশ নেয়া বিনিয়োগকারীরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেন। গত ১০ মাসেও শেয়ারবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। তারা অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এসব বক্তব্যের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও দাবি জানান তারা।
ডিএসই চত্বর থেকে প্রেস ক্লাব : পুলিশি বাধার মুখে আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীরা ডিএসই চত্বর থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। তারা নিরাপত্তা এবং আন্দোলনের স্বার্থে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিনিয়োগকারীরা প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিতে চাইলে সেখানেও পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। উপায় না দেখে তারা প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় অবস্থান নেন। বিকাল ৫টা পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান নিয়ে অনশন চালিয়ে গেছেন। তবে প্রেস ক্লাবে অবস্থান না নিতে পারলে শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়ার কথা তারা ভাবছেন।
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা : দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গতকাল বেলা ২টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে শাহাদাত উল্লাহ ফিরোজ বলেন, আমাদের অনশন চলবে। আমরা এখন প্রেস ক্লাবে অবস্থান নিয়ে অনশন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে কতক্ষণ থাকতে পারব, বলতে পারছি না। প্রয়োজনে শহীদ মিনার বা হাইকোর্টের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘ ১০ মাস পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। যদি তা না হয়, হরতালসহ কঠোর আন্দোলন পালনের ডাক দেয়া হবে।
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা : শেয়ারবাজারে পুঁজি হারানোর পর এবার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। ঐক্যপরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী নজরুল ইসলাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রেস ক্লাবে এসেও আমরা পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছি। মনে করেছিলাম প্রেস ক্লাবে এসে আমরা কর্মসূচি পালন করতে পারব। এখানেও তা পারিনি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কি অন্যায় করেছিলাম? এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, আমাদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। আমরা পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছি। গত ১০ মাস ধরে ডিএসই ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করে আসছি। কিন্তু এখন পুলিশ আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সবসময় সাদা পোশাকের পুলিশ আমাদের পেছনে পেছনে থাকে। বাসায় গিয়েও নিরাপদ থাকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তিনি সরকারের কাছে সব বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা দাবি করেন।
সংহতি প্রকাশই কাল হলো : রোববার আমরণ অনশন কর্মসূচিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংহতি প্রকাশ করে। এই সংহতি প্রকাশই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে—এমন মন্তব্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। বিভিন্ন দলের সংহতি প্রকাশের ফলে বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় সরকারের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। ডিএসই ভবনের সামনে বিনিয়োগকারীদের অবস্থান করতে দিলে আরও অনেকেই সংহতি প্রকাশ করবে। এই কর্মসূচি একপর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সরকারের বিভিন্ন মহলে। এ কারণে সরকার যে কোনোভাবে শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আন্দোলন দমাতে তত্পর হয়ে ওঠে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নই। গত ১০ মাসে বিরোধী দল হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। যদি তা-ই হতো, তাহলে আমরা সেসব আন্দোলনে সমর্থন দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারী। রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই আমাদের। রোববার সংহতি প্রকাশ করতে যারা এসেছেন, আমরা তো তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না।
৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন : পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন ও বিধিবিধানসহ প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে উপদেশ দেয়ার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেছে সরকার। কাউন্সিলের অপর সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আনিসুল হক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পদমর্যাদার যুগ্ম সচিব পরিষদের সদস্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। গঠিত পরিষদ কীভাবে কাজ করবে, তার কার্যবিধি অর্থ মন্ত্রণালয় ঠিক করবে বলে জানা গেছে।
লেনদেন : লেনদেনে বড় ধরনের ধস নামলেও ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে। সূচকের বড় ধরনের ওঠানামা শেষে দিনশেষে ৩৬ দশমিক ৮৭ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৪২৩ দশমিক ৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ১৭৮টির, কমেছে ৭১টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ১০টির।
বিনিয়োগকারীদের ওপর হামলার নিন্দা : এদিকে অনশনরত বিনিয়োগকারীদের ওপর পুলিশি হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের সব দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবৃতিতে বলেন, শেয়ারবাজারে অর্থ লোপাটকারী চিহ্নিত ব্যক্তি ও হাউজগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে দমন-নির্যাতন চালিয়ে সরকার পুঁজিবাজারের সর্বনাশ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তিনি বিনিয়োগকারীদের সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

No comments

Powered by Blogger.