এইচএসসির ফল জালিয়াতি যশোর বোর্ডে

লতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণে জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। জালিয়াতকারী যশোর শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ পাঁচজনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বোর্ডের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে শোকজ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, 'এ ধরনের জালিয়াতির কাজ আগেও হতো। কেউ ধরেনি। আমরাই প্রথমবারের মতো ধরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম।'


পাঁচ জালিয়াতিকারীর মধ্যে যশোর বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আজমল গণিকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে মাউশি অধিদপ্তরে ন্যস্ত করে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বোর্ডের সেকশন অফিসার মো. ফজলুর রহমান, সিস্টেম এনালিস্ট মো. জাহাঙ্গীর কবির, সহকারী প্রোগ্রামার মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এবং ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. আবদুর রাজ্জাককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
যশোর বোর্ডের ২০১১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ২৫ হাজার ৩৫৬টি উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার জন্য সাত হাজার ২৪২ পরীক্ষার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে ৭৯৬টি উত্তরপত্রের পুনর্নিরীক্ষা খসড়ায় এবং কম্পিউটার শিটে নম্বর পরিবর্তন না করে সরাসরি চূড়ান্ত ফলাফল শিটে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর পুনর্নিরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। এর পরই ফল পুনর্নিরীক্ষণে অনিয়মের প্রমাণ পায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তদন্ত প্রতিবেদন : ফল পুনর্নিরীক্ষণের এই জালিয়াতির অভিযোগে গত ৭ সেপ্টেম্বর চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যশোর সরকারি এম এম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এস এম ইবাদুল হককে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন যশোর সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আহসান হাবীব, যশোর সরকারি সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান এবং যশোর বোর্ডের প্রধান মূল্যায়ন অফিসার মিজানুর রহমান। তদন্ত কমিটি যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ বোর্ডের ৯ কর্মকর্তা এবং ৮৬ জনের মধ্যে ২২ জন পুনর্নিরীক্ষকের লিখিত বক্তব্যসহ তাঁদের সাক্ষাৎকার নেয়। কমিটি গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ করে।
ওই কমিটি সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মোট ১৩ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদনটি কালের কণ্ঠও পেয়েছে। প্রতিবেদনে শুরুর দিকে অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি অভিযুক্তদের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ১৬ জনের রোল নম্বরের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, পুনর্নিরীক্ষায় ফল পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের শেষের দিকে ফল জালিয়াতি রোধে কমিটির ১২ দফা সুপারিশ রয়েছে।
জালিয়াতির শিকার ১৬ জন : ৪০৯৮০৪ রোল নম্বরের প্রার্থীর পাঁচটি বিষয়ে নম্বর পরিবর্তিত হয়েছে। আগের ফলে এই প্রার্থী অকৃতকার্য ছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৩ দশমিক ৬০ পেয়েছেন। প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়েছে, উত্তরপত্রে পরিবর্তন নেই, সরাসরি চূড়ান্ত শিটে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। ৪০৩৪৪৪ রোল নম্বরের প্রার্থীর চারটি বিষয়ে নম্বর পরিবর্তিত হয়েছে। আগের ফলে এই প্রার্থী অকৃতকার্য ছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৪ পেয়েছেন। প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়েছে, উত্তরপত্রে পরিবর্তন নেই, সরাসরি চূড়ান্ত শিটে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। ৪০০৫০৩ রোল নম্বরের প্রার্থীর তিনটি বিষয়ে নম্বর পরিবর্তিত হয়েছে। আগের ফলে এই প্রার্থী জিপিএ-৪ দশমিক ৬০ পেয়েছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
মন্তব্যে বলা হয়েছে, উত্তরপত্রে পরিবর্তন নেই, সরাসরি চূড়ান্ত শিটে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে ৬০০৬৭১ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে। আগের ফলে এই প্রার্থী জিপিএ-৪ দশমিক ৫০ পেয়েছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৪ দশমিক ৭০ পেয়েছেন। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করে উত্তরপত্রে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে ৪০০৫৮৩ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে। আগের ফলাফলে এই প্রার্থী অকৃতকার্য ছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-২ দশমিক ৮০ পেয়েছেন। পুনর্মূল্যায়ন করে উত্তরপত্রে দুটি বিষয়ে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে ৪০০৫৮৭ রোল নম্বরের প্রার্থীর। আগের ফলে এই প্রার্থী জিপিএ-৩ পেয়েছিলেন। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৩ দশমিক ২০ পেয়েছেন।
এভাবে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করে উত্তরপত্রে নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে ৫০৮৩৫২ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৬০৭২৮৭ রোল নম্বরের প্রার্থীর একটি বিষয়ে, ৬০৯১৯৮ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৪০৬২৭০ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৪০৬২৮৩ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৪০৬৪৪৯ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৬১৫৬০৩ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৪০৯৭৮৯ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে, ৫৩৬৭৩৬ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে ও ৪১৩১৩০ রোল নম্বরের প্রার্থীর দুটি বিষয়ে।
শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেছেন, বিধি অনুযায়ী উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই। শুধু পুনর্নিরীক্ষণ করা যায়। তার পরও যারা এই অনিয়মের সাথে জড়িত, তাদের রেহাই দেওয়া হবে না।
প্রতিবেদনের সুপারিশ : ভবিষ্যতে ফলে যাতে আর জালিয়াতির ঘটনা না ঘটে সেজন্য তদন্ত কমিটি ১২ দফার সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে_ পুনর্নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে পরীক্ষা শাখার সবাইকে নিয়ে সভা করতে হবে। পুনর্নিরীক্ষার কাজ শুরু করার আগেই একদল অভিজ্ঞ পুনর্নিরীক্ষকের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এইচএসসির উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পুনর্নিরীক্ষার কাজ শুরুর আগেই পুনর্নিরীক্ষকদের উপস্থিতিতে সভা করে নীতিমালাটি বিতরণ করতে হবে। ওই সভায়ই পুনর্নিরীক্ষণের প্রয়োগের কৌশল নির্ণয় করতে হবে। পুনর্নিরীক্ষণে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ছক সরবরাহ করতে হবে। পুনর্নিরীক্ষকরা বিধিমালা অনুযায়ী কাজ করছেন কি না, তা পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করতে হবে। পুনর্নিরীক্ষকরা কতটি বিষয় ও পত্রে কত সংখ্যক উত্তরপত্রের নম্বর পরিবর্তন করেছেন, তার সংখ্যা উল্লেখ করে মন্তব্য ও স্বাক্ষরসহ খসড়া ও কম্পিউটার শিটে জমা নিতে হবে। খসড়া ও কম্পিউটার শিটের নম্বর যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষরসহ কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রির জন্য পাঠাতে হবে। এর পর কম্পিউটার শিটের সঙ্গে ডেটা এন্ট্রির ফল মিলিয়ে নিতে হবে। পুনর্নিরীক্ষণের সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা সমন্বয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে যশোর বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আজমল গণি, সেকশন অফিসার মো. ফজলুর রহমান, সিস্টেম এনালিস্ট মো. জাহাঙ্গীর কবীর, সহকারী প্রোগ্রামার মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এবং ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যশোর বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. সেলিম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। একইভাবে বোর্ডের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল হুদাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : ফলাফলের এই জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী সংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, পুনর্নিরীক্ষার মতো একটি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে যশোর বোর্ডে ফল প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সতর্কতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়নি। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে পুনর্নিরীক্ষার পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে উত্তরপত্রে অনিয়ম এবং অনৈতিকভাবে নম্বর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খসড়া শিটে নম্বর পরিবর্তন না করে সরাসরি কম্পিউটার শিটে অন্য হাতে নম্বর উত্তোলিত হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, 'এটা বড় ধরনের দুর্নীতি। এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। এ ঘটনায় দায়ীদের কখনো ক্ষমা করা সম্ভব নয়। এ ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।' মন্ত্রী বলেন, আর এ ঘটনার ফলে আশা করি অন্যরাও সিগন্যাল পেয়ে যাবেন যে শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি করে রেহাই পাওয়া যাবে না।
মন্ত্রী বলেন, কর্তব্যে অবহেলার জন্য যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. সেলিমের বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে চিঠি পাঠানো হবে। এ ছাড়া কর্তব্যে অবহেলার জন্য তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী (বর্তমানে বোর্ডের সচিব) অধ্যাপক মো. কামরুল হুদাকেও শোকজ করা হবে বলে। মন্ত্রী বলেন, যেসব উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার পরিবর্তে পুনর্মূল্যায়ন করে নম্বর বাড়ানো হয়েছে তা পুনরায় পরীক্ষা করে 'কেস টু কেস' সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ফল পুনর্নিরীক্ষণের অনিয়মে কোন শিক্ষার্থী কিভাবে জড়িত তাও 'কেস টু কেস' বের করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ অন্য কর্মকর্তারা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁদেরকেও রেহাই দেওয়া হবে না। অতীতে যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাও খুঁজে বের করা হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.