অর্থহীন ম্যাচ তবু কী অর্থবহ! by নোমান মোহাম্মদ,

ই রকম ম্যাচের গালভরা একটা নাম আছে। আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচ। সিরিজের নিষ্পত্তি সারা, শেষ ম্যাচের জয়-পরাজয়ে কিছুই যায়-আসে না, তবু নিয়মরক্ষার খেলাটি খেলতেই হবে। সুযোগ থাকলে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো দলই কি আপাত অর্থহীন এই ম্যাচ খেলতে চাইত?দাঁড়ান, দাঁড়ান। অন্যান্য 'ডেড রাবার'-এ যা খুশি হোক, এই সিরিজের ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও তেমন নয়। আজ জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে দিন-রাতের শেষ ওয়ানডে অন্য কারণে পুরোমাত্রায় 'অ্যালাইভ'। মাঠে নামতে উন্মুখ তাই দুই দলই।


ক্যারিবীয় শৌর্যে গর্জে উঠে প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর কিছুটা হলেও সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ। ভিন্ন সমীকরণের সামনে দাঁড়ানো দুই দলের আবহে তাই রোমাঞ্চের অনেক উপকরণই বিদ্যমান চট্টগ্রামের ম্যাচটিতে।
কাল ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে আর আসেননি মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশ অধিনায়ক অবশ্য দ্বিতীয় ম্যাচের পরই বলেছিলেন শেষ ম্যাচ ঘিরে তাঁর প্রত্যাশা, 'অবশ্যই সিরিজ থেকে এখনো অনেক কিছু পাওয়ার আছে আমাদের। প্রথম দুই ম্যাচে আমরা ভালো খেলতে পারিনি। এখন শেষ ম্যাচে ভালো খেলে অন্তত একটি জয় নিয়ে সিরিজ শেষ করা আমাদের লক্ষ্য। তাহলে টেস্ট সিরিজটা শুরু করতে পারব আত্মবিশ্বাস নিয়ে।' কাল অনুশীলনে ঘাম ঝরানোর ফাঁকে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ড্যারেন সামিও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর চাওয়া, 'আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা যদি কাল (আজ) হেরে যাই, তাহলে সিরিজ জিতব ২-১ ব্যবধানে। সে ক্ষেত্রে কোনো র‌্যাংকিং পয়েন্ট যোগ হবে না। আর যদি ৩-০ ব্যবধানে জিততে পারি, তাহলে চার র‌্যাংকিং পয়েন্ট যোগ হবে। এ জন্য এই ম্যাচটির গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক।'
বোঝা গেল। সিরিজের ট্রফির গন্তব্য নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও ম্যাচটিকে এতটুকু হালকাভাবে নিতে রাজি নয় কোনো দলই। কিন্তু আগে খেলাটি হতে হবে তো! বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা মেঘ কাল দুপুরে বৃষ্টি হয়ে অঝোরে ঝরেছে চট্টগ্রামে। তখন থেকেই উইকেট ঢাকা কাভারে। শুধু ওই পিচ নয়, মোটামুটি পুরো মাঠই ঢেকে রাখা হয়েছে। কারণ গোমড়ামুখো আকাশ আবার কখন কেঁদে ওঠে! আর এই স্টেডিয়ামের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মিরপুরের মতো নয় যে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। কিউরেটরের কালকের রাতটি তাই নির্ঘুমই কাটার কথা। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আরেক দফা বৃষ্টি হলেই যে সর্বনাশ!
তবে বৃষ্টিকে মাথায় রেখে তো আর প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। দুই দল প্রস্তুতি নিয়েছে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী। বিস্ময়কর হলো, স্বাগতিক দল হয়েও সিরিজে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজেদের শক্তির সেই সুবিধাটা নিতে পারেনি। মিরপুরের স্টেডিয়ামের দুটি ম্যাচের উইকেটই যে ছিল স্পিন-বৈরী। অথচ বাংলাদেশ বরাবরই স্পিননির্ভর দল। স্পিনারদের সঙ্গে যদি মাঝের ওই ২২ গজের মিতালি না হয়, তাহলে জয়ের সম্ভাবনাও সরে যায় দূর থেকে আরো দূরে। কিউরেটর সূত্রে খবর, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট সাহায্যের হাত বাড়াবে সাকিব আল হাসান, আবদুর রাজ্জাক, নাঈম ইসলামদের দিকে। এখন সেটি কাজে লাগাতে পারলেই হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা নাসির হোসেন আরো বেশি স্পিনসহায়ক উইকেটের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে গেছেন। প্রথম দুই ম্যাচ থেকে স্পিনাররা মাত্র দুই উইকেট পাওয়ায় এটি নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের দুশ্চিন্তা দূর করার চ্যালেঞ্জ থাকছে ঘূর্ণি বলের ঘাতকদের সামনে। সামি অবশ্য উইকেট নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে নারাজ, 'বাংলাদেশে সাধারণত স্পিনিং ট্র্যাকই হয়। তবে আমি আমার বোলারদের সামর্থ্য জানি। তারা যখন লাইন-লেন্থ মেনে ফাস্ট বোলিং করে, যেকোনো উইকেটেই তা কাজে দেবে। আশা করি প্রথম দুই ম্যাচের মতো কালও তারা পেশাদারি দক্ষতায় নিজেদের কাজটুকু করতে পারবে।'
বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার জায়গা আছে আরেকটি। টপ অর্ডার। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার পুরনো রোগটি যে দ্বিতীয় ম্যাচে দেখা দিল নতুন করে। ১ রানে নেই ৩ উইকেট, ১৮ রানে ৪! শঙ্কা থাকলেও টপ অর্ডারের পক্ষেই কাল ব্যাটিং করেছেন নাসির, 'টপ অর্ডারের সবাই অভিজ্ঞ। আর তাঁরা চেষ্টাও করছেন খুব। আসলে সবারই তো খারাপ সময় যায়। আশা করি, সামনে তাঁরা রান পাবেন।' টপ অর্ডারের ব্যর্থতার বলি হতে পারেন আজ মোহাম্মদ আশরাফুল। প্রথম ম্যাচে ৩ বলে ২ এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ৫ বলে শূন্য করার খেসারত দিয়ে আজ দর্শক বনে যেতে পারেন তিনি। নেটে শাহরিয়ার নাফীসের মনোযোগী অনুশীলনও সেই ইঙ্গিতবাহী।
আবহাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, উইকেট নিয়ে শঙ্কা, স্পিন আক্রমণ ও টপ অর্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তা_তৃতীয় ওয়ানডের আগে ইতিবাচক কিছুই কি বাংলাদেশের পক্ষে? আছে। ইতিহাস। এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ১৩টি ওয়ানডের মধ্যে ছয়টিতে জিতেছে স্বাগতিকরা। দুটি পরিত্যক্ত ম্যাচের পাশাপাশি হেরেছে মাত্র পাঁচটিতে। অর্থাৎ এখানে ওয়ানডেতে হারের চেয়ে বাংলাদেশের জয় বেশি। এই স্টেডিয়ামে সর্বশেষ তিন ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। যা শুনে ক্যারিবীয় অধিনায়ক সামির সহাস্য মন্তব্য, 'আমরা চেষ্টা করব বাংলাদেশের সেই জয়ের ধারা রুখতে।' কিন্তু ধারে-ভারে অনেক এগিয়ে থাকা ইংল্যান্ডই তো তা পারেনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট রূপকথায় চিরন্তন অংশ হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে কোণঠাসা বাংলাদেশ কী দুর্দান্তভাবেই না জয় ছিনিয়ে এনেছিল!
বঙ্গোপসাগর থেকে গাংচিলের ডানায় ভর করে ভেসে আসা সেই সৌভাগ্যের ছোঁয়া আজ আরেকবার খুব করে চাইবে মুশফিকুর রহিমের দল। বছর দুয়েক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গিয়ে তাঁদের ধবল ধোলাই করে আসার স্মৃতিটা যে বুমেরাংয়ের মতো ফিরিয়ে আনা যাবে না কিছুতেই!

No comments

Powered by Blogger.