এ ভূমিকম্প হুঁশিয়ারি সংকেত, বড় বিপদ তো সামনে by আনিসুল হক
রিখটার স্কেলে ৫.৭ বলছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসের সিসমিক অবজারভেটরি ও রিসার্চ সেন্টার। আর যুক্তরাষ্ট্র বলছে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫.৫।
একটা ধাক্কা দিয়ে, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প আমাদের সতর্ক করে দিল। ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। শত শত আহত প্রধানত পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে, কেউ–বা ভবন থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে।
অনেক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে, বেশ কিছু ভবন হেলে পড়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন জ্বলেছে, মাঠের মাটি দুভাগ হয়ে গেছে, ঘরের জিনিসপত্র তাক থেকে পড়ে গেছে।
আরেকটু বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে?
বাংলাদেশের সেরা কাঠামো-প্রকৌশলী শামীমুজ্জামান বসুনিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫। তিনি বলেছিলেন: ‘ভূমিকম্প হলে আমাদের যা হবে…যারা বেঁচে যাবে, তারাও থাকতে পারবে না।
এখানে বীভৎস অবস্থা হবে। আগুন, পানি এবং পয়ঃপ্রণালির যে সিস্টেম আমাদের, এগুলোর যে অবস্থা, এগুলোকে সরাতেও পারবা না। এগুলোর গন্ধে কেউ থাকতে পারবে না।
আগুন তো আছেই। প্লাস এগুলোর যে অবস্থা, তুমি ক্লিয়ারই করতে পারবা না।
ভূমিকম্প এক্সপার্ট যেটা বলে, আমিও বিএসএর আর্থকোয়েক সোসাইটির মেম্বার, সেখানে ওরা দেখেছে যে ভূমিকম্প কত বছর পরপর একটা রিপিটেশন হয়।
যে ফল্টগুলো আছে, সেগুলো মুভ করছে। প্রতিটি আলাদা মুভ করে। কোনোটা একই ডিরেকশনে মুভ করে, কোনোটা উল্টো দিকে করছে।
এটার মধ্যে দুই জয়েন্টগুলো, যেগুলো আছে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ডিফিকাল্ট জায়গা। ডাউকি ফল্ট আমাদের সিলেটের ওপর দিয়ে আছে, এটাও একটা।
ভূমিকম্প ডেইলি হচ্ছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস দেখলে মনে হয় যে ডেইলি ২ মাত্রা বা ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। এগুলো আমরা ধরি না।
ফলে একটা ভূমিকম্প যদি হয়, আমি জানি না কী হবে। এখানে বড় বড় এক্সপার্ট, ওনারা যারা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন, দেড় লাখ বিল্ডিং এখানে ভালনারেবল।
আমি বলব, ‘একসেপ্ট ফিউ বিল্ডিংস অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল। ইদানীং আমাদের ডিজাইনাররা ভেরি স্ট্রং ডিজাইন করছে। এগুলো ছাড়া অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল।’
অর্থাৎ তিনি বলছেন, ‘অল্প কিছু ভবন ছাড়া বাংলাদেশের সব স্থাপনাই ভূমিকম্পের সামনে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে।’
২.
৫.৭ থেকে যদি ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, মহাপ্রলয় হবে ঢাকায়। এবং দেশের অনেক জায়গায়।
ভূমিকম্পে ভবন ধসে তো মানুষ মারা যাবেই, প্রধান বিপদ আসবে আগুন থেকে। সারা শহরের এখানে ওখানে আগুন জ্বলে উঠবে।
এখন মনে করুন, ২০ অক্টোবর ২০২৫ ঢাকার বিমানবন্দরের কার্গো গুদামে আগুন লেগেছিল। এই আগুন নেভাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।
অথচ এই ধরনের কেপিআই এলাকায় আগুন লাগলে অ্যালার্ম বেজে ওঠার কথা স্বয়ংক্রিয়ভাবে, সিসিটিভিতে ধোঁয়া দেখে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির ধারা বর্ষিত হওয়ার কথা এবং ঘটনাস্থলেই ফায়ার ব্রিগেড থাকার কথা।
সেই সংরক্ষিত এলাকার আগুন আমরা সামলাতে পারি না। এখন কল্পনা করুন, সারা শহরে ৫০০টা ভবন ভেঙে গেছে, রাস্তাঘাটে বিদ্যুতের খুঁটি ভাঙা ইট কংক্রিট পড়ে রাস্তাকে অচল করে রেখেছে, এর মধ্যে ২৫টা জায়গায় একসঙ্গে আগুন জ্বলে উঠেছে, তখন কী হবে?
৩.
২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবাজারের আগুনের পর একটা লেখা লিখেছিলাম। সেটা এখন আবার তুলে ধরি—
সিদ্দিকবাজারে একটা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে, সম্ভবত গ্যাস থেকে। ৭ মার্চ ২০২৩। সে সময়ও আমরা বুঝতে পারি, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি, সরঞ্জাম, রসদ, যন্ত্রপাতি কত অপর্যাপ্ত।
মাত্র একটা ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। একই অসহায়ত্ব আমরা বোধ করেছিলাম কিছুদিন আগে, যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে।
এ থেকে যে দুশ্চিন্তা মনে হানা দেয়, তা হলো, একটা জায়গায় আগুন লাগলে, একটা ভবনে বিস্ফোরণ হলে আমরা সামলাতে পারি না।
উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে বুঝতে পারি, আমাদের সীমাবদ্ধতা কত সীমাহীন। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ, আল্লাহ না করুন, যদি এ ঢাকা শহরে কখনো আঘাত হানে, আমরা কী করব?
আমরা জানি, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের শঙ্কার মুখে আছে। গত ৪ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ইফতেখার মাহমুদের প্রতিবেদন, ‘দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা।
‘সব এলাকাই ঢাকা থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে; কিন্তু সেখানে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা ঢাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।’
আমরা যে একটা বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছি, দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় তা উঠে এসেছে।
বলা হচ্ছে, বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার বহু ভবন শুধু বিধ্বস্ত হবে, তা-ই নয়, আসল ক্ষতিটা হবে আগুন থেকে।
আমাদের ভবনে ভবনে গ্যাসের লাইন, মুহূর্তে পুরো শহর জ্বলে উঠবে। এখন হরর মুভির মতো দৃশ্য কল্পনা করুন।
একটা রানা প্লাজা ধসের সময় আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেও কত সামান্যই করতে পেরেছিলাম, একটা সিদ্দিকবাজারের সময় আমরা কতটা অসহায় বোধ করেছিলাম, এক বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে আমাদের কতটা বেগ পেতে হয়েছিল।
এখন যদি একসঙ্গে ১ হাজার রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে, একসঙ্গে যদি ১০০ বঙ্গবাজার জ্বলে ওঠে, একসঙ্গে যদি ৫০০ সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরিত হয়, এ শহরের হবেটা কী!
আপনারা ভাবছেন, আমি কেন বলছি যে এতগুলো ভবন একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি আসলে কমিয়ে বলছি।
বিবিসি বাংলার ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর খবরটা পড়ুন—‘২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।...এ ছাড়া উদ্ধারকাজের সহায়তার জন্য ২০১৯ সালে ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে আরও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ হাতে পাবে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল।’
এখন বুঝুন, বাস্তবতাটা! এক সিদ্দিকবাজার, এক সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা, এক বঙ্গবাজারের বিপর্যয় আমরা সামলাতে পারি না।
বঙ্গবাজারে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের জন্য প্রধান বাধা হয়ে উঠেছিল মানুষের ভিড়। মানুষের ভিড়ে গাড়িগুলো চলতে পারছিল না, কর্মীরা কাজ করতে পারছিলেন না।
কোথায় আমাদের ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি! ২০১৭ সালের চ্যানেল আই অনলাইন খবর থেকে জানা যায়, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘ভূমিকম্প আমি প্রস্তুত’ শিরোনামে প্রচারণার লোগো উন্মোচন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল।
সে সময় ৬০ কোটি টাকার তাঁবু, ২৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনাসহ ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়।
তাঁবুগুলো কই? তা দিয়ে কী হচ্ছে?
আমরা আমাদের শহরটিকে পরিকল্পনার মধ্যে আনব না, আমরা আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট করব, ডিএপি মানব না, ভবন বানানোর সময় মাটি নিরীক্ষা করব না, ভূমিকম্প ও দুর্যোগসহনীয় ভবন বানাব না, জরুরি নির্গমন পথ রাখব না, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলার পথ রাখব না, গলিগুলো বানিয়ে রাখব অপ্রবেশ্য, আগুন নেভানোর যন্ত্র রাখব না, নিরাপত্তা নির্দেশিকা মানব না; আমাদের রাস্তায় একটাও ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকবে না, আমরা ফায়ার ড্রিল করব না, আমরা ঘনবসতির এলাকায় বিস্ফোরক রাখব, রাসায়নিক রাখব; আমাদের মার্কেটগুলোকে আমরা একেকটা বিপজ্জনক ফাঁদ বানিয়ে রাখব; আমরা কোনো নিয়মকানুন মানব না; আমাদের কারখানাগুলো কেউ পরিদর্শন করবেন না, ভবনগুলো কেউ নজরদারিতে রাখবেন না এবং আশা করব, দুর্যোগ এলে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা আমাদের রক্ষা করবেন এবং ভবন ভেঙে গেলে আমরা ৬০ কোটি টাকার তাঁবুতে থাকব!
আসলে আমরা একটা সার্বিক নিয়মহীনতার মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের অর্থগৃধ্নুতা সব নিয়মকানুন তছনছ করে ফেলেছে। লোভের লেলিহান শিখাই পুড়িয়ে ফেলছে সব প্রতিষ্ঠান, নিয়ম, নির্দেশিকা, ম্যানুয়াল, প্রটোকল, আইনকানুন, সুশাসন বলতে যা বোঝায়, তা থেকে আমরা সহস্র যোজন দূরে।
একটা করে দুর্ঘটনা ঘটবে, তারপর আমরা বলব, এই ভবনের অনুমতি ছিল না, এই বাসের ফিটনেস ছিল না, এই এলাকায় রাসায়নিক রাখার কথা নয়, এই বাজার আগেই বিপজ্জনক বলে ঘোষিত ছিল। এখন যেমন আমরা বলছি, ঢাকায় পুকুর, হ্রদ, জলাশয়গুলো গেল কোথায়?
আমরা একটা মহাবিপর্যয়ের লাল সংকেতের মুখে আছি। এখন প্রকৃত আশাবাদীর পক্ষে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নেই।
অরুন্ধতী রায় ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ শেষ করেছেন এভাবে, ‘একটা গুবরে পোকা চিৎ হয়ে আকাশের দিকে পা উঁচু করে আছে। আকাশটা যদি ভেঙে পড়ে, সে পাগুলো দিয়ে ঠেকাবে।’
বনানীর আগুনের সময় একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। দমকলের ফুটো পাইপ পলিথিনে পেঁচিয়ে হাত দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে একটি শিশু।
পরে শিশুটিকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এবারও এমন একটি ছবি দেখলাম। জানি না ছবিটা কার তোলা, এবারের নাকি আগেরবারের।
এই গুবরে পোকাটা আকাশের ভেঙে পড়া ঠেকাতে পারবে না। তবু সে চেষ্টা করছে। বঙ্গবাজারে লুটপাট করা, দমকল অফিসে হামলা করা, রাস্তায় ভিড় করে বাধা তৈরি করা জনতার বিপরীতে এই শিশুই আমাদের আশা জোগায়।
যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই নৈরাজ্যের স্রোতের বিপরীতে নিয়মকানুন, আইনের শাসন, সুশাসন, নিরাপত্তা বিধান ও পদক্ষেপ নেওয়ার কাজটা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। যদি আমরা ব্যর্থ হই, তবু আমাদের চেষ্টা ছাড়া যাবে না।
* আনিসুল হক, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক
![]() |
| ভূমিকম্পের কারণে বাইরে বেরিয়ে উঁচু ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক জনতা। রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা। ছবি: দীপু মালাকার |

No comments