জাহিন মিয়া খুব আনন্দে আছে by মোকাম্মেল হোসেন

আলো-অন্ধকারের খেলা বলতে যা বোঝানো হয়ে থাকে, সিঁড়িতে এখন সেই পরিবেশ বিরাজ করছে। এরকম একটা পরিবেশে চিনি বেগমের সঙ্গে আমার দেখা হল। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে কুশল জানতে চাওয়া সাধারণ ভদ্রতার বিষয়। আমি ভদ্রতা রক্ষায় তৎপর হলাম। ভদ্রমহিলার মুখে কথা ফোটার আগেই হাসি ফুটল।
কোনো কোনো রমণীর হাসি এমন- মনে হয় যেন শিশির ঝরছে। এমন শিশিরের রূপ-মাধুর্য উপভোগ করার সময় নেই যে পুরুষের, নিঃসন্দেহে সে হতভাগা। হতভাগাদের তালিকায় নিজের নাম দেখতে চাচ্ছি না- চিনি বেগম কি তা বুঝতে পারল? পারলে পারুক; কোনো সমস্যা নেই। দৃষ্টি যদি হয় নিষ্পাপ, মন যদি হয় নিষ্কলুষ, তাহলে সৌন্দর্য উপভোগ করার মধ্যে কোনো পাপ নেই। তারপরও মানুষের মন বলে কথা! আমার মনে পাপ-পুণ্যের দ্বন্দ্ব চলছে, চিনি বেগম বলে উঠল-
: বাপ-ছেলে একসঙ্গে সাইজ্যা-গুইজ্যা কই রওনা হইছেন?
চিনি বেগমের মুখের কথা কি তার হাসির চেয়েও মধুর? আমার মনে হল, তার হাসি যদি শিশিরকণা হয়; তাহলে কথা হচ্ছে, জলের বুকে আছড়ে পড়া বৃষ্টিধারা। শিশির ও বৃষ্টির ভেজা গন্ধ গায়ে মেখে উত্তর দিলাম-
: স্কুলে যাইতেছি।
- ছেলেরে ভর্তি করাইতে?
: না। লটারির ফলাফল জানতে।
- কিসের লটারি?
: প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার লটারি।
আজ লটারিতে জাহিন মিয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পাবে। আর ভাগ্য যদি পিছলা মারে, তাহলে পাবে না। জাহিন মিয়া ভর্তি-লটারি জিতলে আমার ‘রি-কন্ডিশন’ মার্কা চেহারায় এক ধরনের স্বস্তি ফুটে উঠেবে, আর লটারি জিততে না পারলে চেহারা ভসকাবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ভসকানো চেহারা নিয়ে তখন দৌড়াতে হবে বেসরকারি কোনো স্কুলে। বেসরকারি বিদ্যাপীঠের কথা মনে হতেই শরীরে জ্বর-জ্বর ভাব অনুভূত হল। জাহিন মিয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অত্যন্ত চড়ামূল্যে বিদ্যা কেনার প্রয়োজন যাতে না পড়ে, সেজন্য আল্লাহপাকের দরবারে আর্জি পেশ করতে করতে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছলাম।
সামান্য দূরে লবণ বেগম দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, একখণ্ড বরফ। গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই বরফখণ্ডের শীতলতা টের পেলাম। আগুনের তাপে বরফ গলে পানি হবে ভেবে হাসি-আগুন প্রজ্বলিত করলাম। কোনো লাভ হল না। বরফখণ্ড হিমশীতল কণ্ঠে বলল-
: চাইরতলা থেইকা নিচতলা পর্যন্ত আসতে কতগুলা সিঁড়ি ডিঙ্গাইছ তুমি?
লবণ বেগম কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছে? এটা কী রকম প্রশ্ন! মুখে ফ্যাকাসে হাসির উদগিরণ ঘটিয়ে উত্তর দিলাম-
: এইটা তো গুনি নাই!
- যাও, গুইন্যা আস।
: মানে?
- মানে চাইরতলা থেইকা নিচতলা পর্যন্ত কয়টা সিঁড়ি আছে, তোমারে সেইটা গুইন্যা আসতে বলছি।
: কী আশ্চর্য! আমি সিঁড়ি গুনতে যাব কোন দুঃখে!
- মানুষ কি সংসারের সব কাজ শুধু দুঃখে করে? আনন্দেও করে। আমি চাই, সিঁড়ি গুনার কাজটা তুমি আনন্দের সঙ্গে করবা।
: তাসিনের আম্মু! এইটা কিন্তু চূড়ান্ত রকমের বাড়াবাড়ি হইয়া যাইতেছে!
- মোটেই না।
থুম ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কী করা উচিত- সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে লবণ বেগম বলল-
: কী হইল! দাঁড়াইয়া রইছ কেন? যাও।
সংসার জটিল রণাঙ্গন। এ রণাঙ্গনে যারা সবসময় জয়ী হওয়ার আশা করে, তারা ভুল করে। আমি এ ভুলটা করতে চাই না বলে ব্যাকগিয়ার মেরে সিঁড়িতে পা রাখলাম। প্রতি তলায় ১১ দু’গুণে ২২টা সিঁড়ি। চার তলায় সিঁড়ির সংখ্যা ৪ বাইশে ৮৮। রিপোর্ট পেশ করার পর লবণ বেগম বলল-
: ৮৮টা সিঁড়ি আপ-ডাউন করতে এইবার তোমার সময় লাগছে সাড়ে চাইর মিনিট। অথচ আগের বার শুধু ডাউন করতেই সময় নিছ ১৬ মিনিট। এর রহস্য কী?
এতক্ষণে ফোঁড়ার মুখ খুঁজে পেলাম। বললাম-
: তুমি তো দুম-দুম কইরা নিচে নাইমা আসলা। এদিকে তোমার ছেলে কয়েকটা সিঁড়ি ডিঙ্গানোর পর বইলা বসল...
- কী বইলা বসল?
: আব্বু, থিস করব। তখন আবার বাসায় ঢুকলাম। তারে লইয়া টয়লেটে গেলাম।
- আর?
: আর কী!
- আর কিছু না?
: অঃ। মাঝপথে চিনি বেগমের দেখা হইছে। উনি জানতে চাইলেন, বাপ-বেটা মিইল্যা কই রওনা হইছেন? আমি বললাম, লটারির ফলাফল জানতে।
- শুধু এইটুকই?
: না। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটা প্রেমের কবিতার পুরাটা তারে শুনাইছি।
- ঠিক আছে, চল।
স্কুল প্রাঙ্গণে বিশাল আব্বা-আম্মা সমাবেশ। তাদের সঙ্গে আসা বাচ্চারা নিরুদ্বেগ-নিশ্চিন্তে এটা-ওটা খাচ্ছে, ছুটছে, দৌড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে। পরিবেশ দেখে স্বর্গের বাগান বলে ভ্রম হয়। কয়েক বছর আগেও শহরের সরকারি স্কুলগুলোয় প্রথম শ্রেণীতে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে এ রকম পরিবেশ ছিল না। তখন বাচ্চা-কাচ্চারা হাঁটতে শিখলেই ভর্তিযোদ্ধা হিসেবে খাতায় তার নাম উঠে যেত। সে সময়কার কথা। আমার বড় ছেলে ৪ বছরে পা দিতেই তার ভর্তির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। কেবল সকাল-সন্ধ্যার রুটিন পড়ালেখা নয়, লবণ বেগম রান্না করতে করতে ছেলেকে শব্দার্থ শেখায়, গোসল করাতে করাতে নামতা মুখস্থ করায়, হাগু করাতে করাতে জোড়-বিজোড়ের তালিম দেয়। এক পর্যায়ে লবণ বেগম নিজের ওপর আর ভরসা রাখতে পারল না। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। একদিন এক কোচিং সেন্টারে গেলাম। এর নাম হচ্ছে, বাদল স্যারের সাফল্য এক্সপ্রেস। বাদল স্যারের সাফল্য এক্সপ্রেসের টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন। সিরিয়াল মেইনটেন করে স্যারের সামনে যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনের কোন স্কুল?
নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম-
: অষ্টধার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বাদল স্যার চোখ কুঁচকালেন। বললেন-
: এই ধরনের স্কুলের নাম তো জীবনে শুনি নাই!
- এইটা ময়মনসিংহ সদরের গ্রামের একটা স্কুল। আমি এই স্কুলেই পড়ছি।
- আরে! আপনের স্কুলের কথা জানতে চাইছে কে? বাচ্চারে কোন স্কুলে ভর্তি করাইতে চান- সেইটা বলেন।
: চাই তো একটা ভালো স্কুলেই ভর্তি করাইতে।
- নির্দিষ্ট কইরা বলতে হবে।
: কেন!
- স্কুল অনুযায়ী আমাদের কোচিংয়ের রেট নির্ধারণ করা হয়।
: বুঝলাম না।
- না বোঝার মতো কিছু বলি নাই। ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে ভ্রমণ করলে আপনে যে টাকা দিয়া টিকিট কাটবেন, অন্য ক্লাসে ভ্রমণ করলে কি সেই টাকা লাগবে?
: জ্বি-না।
- সাফল্য এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম। টপ-ওয়ান, টপ-টু, টপ-থ্রি- এইভাবে স্কুলগুলারে সিরিয়াল করা হইছে। সিরিয়াল অনুযায়ী বাচ্চাদের টেক-কেয়ার করা হয়; টাকাও সেইভাবে নেয়া হয়...
বাইরে বের হওয়ার পর লবণ বেগমকে বললাম-
: এইসব এক্সপ্রেস-ফেকপ্রেস সব ভোগাস।
লবণ বেগম আমার কথায় কর্ণপাত করল না। ফার্স্টক্লাসের টিকিট কেটে ছেলেকে সাফল্য এক্সপ্রেসে তুলে দিল।
ভর্তি পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখে সাফল্য এক্সপ্রেসের পুচকে যাত্রীকে নিয়ে স্কুলে গেলাম। শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিতদের বাঁশির হুইসেল, বাচ্চাদের কান্না, অভিভাবকদের চিৎকার-চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি- সব মিলিয়ে বিভীষিকাময় পরিবেশ। একটা বাচ্চাকে দেখলাম, বেঁকে বসেছে- মাকে ছাড়া সে পরীক্ষার হলে ঢুকবে না। মা নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কাজ হচ্ছে না। এরই মধ্যে ঘণ্টা পড়ে গেল, ভদ্রমহিলার তখন মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা। তিনি ঠাস করে মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার আরও বড় আকারের হুজ্জত সৃষ্টি হল। মাইকে অভিভাবকদের বাঁশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থাকার জন্য বারবার অনুরোধ করা হচ্ছিল। কে শুনে কার কথা! ভিড়ের মধ্যে একটা বাচ্চাকে একজন অভিভাবকের কোলে তুলে দিতেই তিনি বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন-
: এইটা তো আমার বাচ্চা না! আপনে কার বাচ্চারে আমার কাছে গছাইয়া দিলেন?
অল্পক্ষণের মধ্যেই বাঁশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে পড়ল। যে যেভাবে পারছে- সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি শেষ হওয়ার পর শুনি, এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকাডাকি করছেন। পাশ থেকে একজন বললেন-
: নাম ধইরা ডাকাডাকির প্রয়োজন কী? মোবাইলে ফোন করেন।
- ফোন বন্ধ পাইতেছি।
পাশ থেকে একজন রসিকতা করল-
: ভাই, টেনশনের কিছু নাই। পুরান গেলে নতুন পাবেন।
কিছুক্ষণ পর আরেক ভদ্রলোককে দেখা গেল, তিনি বৌ-বাচ্চা দু’জনকেই খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন অভয় দিলেন-
: শুধু বউ মিসিং হইলে চিন্তার বিষয় ছিল। সঙ্গে যেহেতু বাচ্চা আছে, চিন্তার কিছু নাই। পাবেন।
ভিড়ের মধ্যে সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের হাতে লাল-নীল ফিতা বেঁধে দিয়েছেন। কেউ কেউ মাথায় নির্দিষ্ট রঙের ক্যাপ পরিয়েছেন। আমার মাথায় এ ধরনের বুদ্ধি কেন আসেনি, তা নিয়ে আফসোস করছি- হঠাৎ ভিড়ের মাঝখানে চিড়ে-চ্যাপ্টা অবস্থায় ছেলেকে আবিষ্কার করলাম। তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কোলে তুলে নিয়ে দৌড় দিলাম, যেন সোনার সিন্দুক খুঁজে পেয়েছি। আহ! কী স্বস্তি। সেই করুণ দৃশ্যের অবতারণা এবার আর নেই।
প্রশাসনের লোকজন চলে এসেছেন। তারা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে চা-সিঙ্গারা দিয়ে আপ্যায়িত হচ্ছেন। আপ্যায়ন পর্ব শেষ হলেই লটারি পর্ব শুরু হবে। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। মা-ছেলেকে স্কুল প্রাঙ্গণে রেখে চলে এলাম।
দুপুরের দিকে লবণ বেগমের ফোন পেলাম। তার গলায় খুশির ঝিলিক। কোনোমতে সে বলল-
: তোমার ছেলে তো লটারিতে টিইক্যা গেল!
- আলহামদুলিল্লাহ। ফোনটা জাহিনরে দেও তো।
ফোন হস্তান্তরিত হওয়ার পর জাহিনের উদ্দেশে বললাম-
: আব্বু, রেজাল্ট পাইছ?
- হুঁ।
: কেমন লাগতেছে?
- ভালো।
: আনন্দ হচ্ছে না?
- হচ্ছে। আব্বু...
: কও।
: তুমি পেপারে লেইখ্যা দেও, জাহিন খুব আনন্দে আছে...
জাহিনের এ আনন্দের পেছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অবদান রয়েছে। তার সরকারের একটা সিদ্ধান্ত অতীত ভর্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিবেশই শুধু বদলে দেয়নি, সেইসঙ্গে অভিভাবকদের হাজার হাজার টাকার সাশ্রয়ও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বাচ্চাদের ব্যাপারে আরও একটি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি তাদের বইয়ের বোঝা কমানোর কথা বলেছেন। সমস্যা হল, প্রধানমন্ত্রীর সব কথা রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ধরে নিয়ে তা পরিপালন করার ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়। বাচ্চাদের বইয়ের বোঝা কমানোর পরামর্শের ক্ষেত্রেও একই উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা ঠিক না। একজন প্রধানমন্ত্রীকে আইন করে সবকিছু বাস্তবায়ন করতে হবে কেন? তার আদর্শ, জীবনাচার এবং পরামর্শও অবশ্য পালনীয় হওয়া উচিত।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokammel@live.com

No comments

Powered by Blogger.