বন্দিত্ব থেকে বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত by তোফায়েল আহমেদ

এখনও আমার স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হাবীব আলীর কথা। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং একই তারিখে ইরান ও তুরস্কের সরকারদ্বয়ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পরদিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যাত্রা করেছিলাম লাহোরের উদ্দেশে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিলেন কুয়েতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এসেছিলেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওআইসির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল, তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা। এ পাঁচজন এসেছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদীনের বিশেষ বিমান নিয়ে। লাহোর বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজলে এলাহী এবং প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেখানে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রেজেন্টেশন লাইনে যারা দণ্ডায়মান ছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের সবার সঙ্গে করমর্দন করলেও টিক্কা খানের সঙ্গে করমর্দন করেননি। কারণ টিক্কা খানের হাত শহীদের রক্তে রঞ্জিত ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাওয়ার সময় লাহোরের রাস্তার দুই পাশে লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ করে স্লোগান তুলেছিল, ‘জীয়ে মুজিব, জীয়ে মুজিব’ অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ, মুজিব জিন্দাবাদ। বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু যখন অতিথিশালায় পৌঁছলেন, তখন সেখানে স্যুট-টাই পরা ছোটখাটো একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করেন। বঙ্গবন্ধুও পরমাদরে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘হাবীব আলী, ইউ আর হেয়ার।’ জানতে পারলাম লোকটির নাম হাবীব আলী। বঙ্গবন্ধু যখন মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি তখন তিনি ছিলেন সেই কারাগারের প্রিজন গভর্নর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের পর তিনি আমাদের কক্ষে আসেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু মিয়ানওয়ালী কারাগারে কীভাবে জীবনযাপন করেছেন, কীভাবে তিনি মুক্তিলাভ করেছেন- সবিস্তারে তার বর্ণনা দেন। গভীর শ্রদ্ধায় স্মৃতি তর্পণ করে একটানা বলে যান মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নয় মাস চৌদ্দ দিনের কঠিন কারাজীবনের কথা। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন- “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশের পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারের দিকে যাই। কারা ফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার ওপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদি ছিল তারা শেখ মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ‘ওরা এসেছে।’ মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমি মাথানত করব না।’ তার আগে মিয়ানওয়ালী কারাগারেই সেলের সামনে একটা কবর খনন করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’ তখন তাকে বলা হয়েছিল যে, ‘যুদ্ধ চলছে, এটা বাংকার। শেল্টার নেয়ার জন্য।’ আসলে ছিল কবর। মুজিবকে একজন কয়েদি বলছিল, ‘আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেয়া হবে।’ তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, ‘কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে এবং আমি এও জানি, যে বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সেদিন তিনি মিনতি করে বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি- সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’
যা হোক, ওইদিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেয়ার জন্য মিয়ানওয়ালী কারাগারে আসি। কারণ এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল, ‘আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমি আমার জীবনে যদি কোনো ভুল করে থাকি তা হল শেখ মুজিবকে ফাঁসি কাষ্ঠে না ঝোলানো।’ তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এই মর্মে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক।’ তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন। তখন আমি তাকে বলি, ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার ওপর আপনি আস্থা রাখুন।’
তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘না, আমার একমাত্র কাজ হল আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি খবরের কাগজ পড়তে পারি?’ আমার উত্তর ছিল, ‘না।’ এরপর বললেন, ‘আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি?’ তখন তাকে এক কাপ চা দেয়া হয়। আমার বাড়িতে তিনি দুই দিন থাকেন। দিনদুই পর শেখ মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে, যেটা একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিণ্ডি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এ শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলেছিল, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে।’ তারপর সেখানে ভুট্টো এলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘নাউ আই অ্যাম দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’ তারপরই শেখ মুজিবের প্রশ্ন ছিল, ‘ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রিম্যান অর প্রিজনার।’ তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’ তখন শেখ মুজিব বললেন, ‘ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ।’ তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন, ‘ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’ এরপর শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপর তিনি অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসঙ্গে থাকা যায় ইত্যাদি। কিন্তু শেখ মুজিব কোনো কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে না পারব, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’ এরপর শেখ মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কি এখন দেশে যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের ওপর দিয়ে যায় না।’ তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাব।’ এরপর ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন।’’
কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ এবং ভুট্টোর সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ শেষে হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা বাঙালিরা গর্বিত ও মহাসৌভাগ্যবান যে, শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা তোমরা পেয়েছ।’ সেদিন হাবীব আলীর স্মৃতিকথা ও মন্তব্য শুনে বিস্মিত হইনি; কিন্তু গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। আমরা তো জানতাম আমাদের নেতার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় সংকল্পের কথা।
প্রতি বছর যখন আমাদের জীবনে ১০ জানুয়ারি ফিরে আসে, তখন জাতির জনককে ঘিরে কত কথা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে। কারণ ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে চিরস্মরণীয় এক অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছিল। যদিও ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল; কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশে বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ পায়নি। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠের নারকীয় বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বের নিপীড়িত-মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু মুজিব জানুয়ারির ৮ তারিখে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধুর লন্ডন আগমনের সংবাদ শোনামাত্র জামুরকাই নামক অবকাশ যাপন কেন্দ্রে ছুটিতে থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ ছুটে আসেন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং ব্রিটিশ রীতি-ঐতিহ্য অনুযায়ী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাগত জানান।
পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য অনুরোধ জানাবে।’ পরিশেষে তিনি বলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ তিনি জনগণের কাছে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ সময়ের বন্দি জীবনের নিঃসঙ্গতা তাকে কাবু করতে পারেনি। জনগণের আরাধ্য প্রিয় নেতা তার মানস জগতে জনতার সাহচর্য লালন করেছেন প্রতিনিয়তই।
যেদিন, ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ জানলাম, সেদিন এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল সারা দেশে। মানুষের যে কী আনন্দ তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। সমগ্র দেশবাসী অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কখন প্রিয় নেতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন। অবশেষে পরমাকাক্সিক্ষত সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি এলো। সেদিন ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে দশদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে। কোটি কোটি হৃদয় রুদ্ধবাক মুহূর্ত গুনছে, প্রতি নিঃশ্বাসে অধীর আগ্রহে কালক্ষেপণ করছে- কখন, কখন আসবেন প্রিয় নেতা? কী দিয়ে তারা বরণ করে নেবে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে, বাঙালির হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ গর্বকে। রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পত্নী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সবাই অধীর আগ্রহে আজ অপেক্ষমাণ দু’হাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য।
ঢাকায় যখন সাজসাজ রব, তখন সকাল থেকে দিল্লির রাজপথ ধরে হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিল্লির জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তার সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন।
দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১-৫১ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতারা, আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তার সংযমের সব বাঁধ ভেঙে যায়। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়বজুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন।
রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে উঠে রওনা দিই। সুদৃশ্য তোরণ, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দুই পাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন ময়দানে পৌঁছলাম তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে ময়দান পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। নেতাকে নিয়ে যখন ময়দানে প্রবেশ করি, কোনো দিকে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আবালবৃদ্ধবনিতার মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে চোখ মুছে চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভায়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা। হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘ভায়েরা, তোমাদের একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘আমি বিশ্বের সব মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। জাতিসংঘেরও উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা।’ পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’
কী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তৃতা! রাষ্ট্রের আশু করণীয় কী হবে, তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, ইঙ্গিতবহ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বক্তৃতা দিলেন বঙ্গবন্ধু। লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে, আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ১৮নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আরেকটি বাড়ি তখন তার জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমণ্ডির ৩২নং বাসভবনটি শত্র“বাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যে তা বসবাসের অনুপযোগী ছিল। ১১ জানুয়ারি প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
আজ জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অবিস্মরণীয় এই ঐতিহাসিক দিনটিতে কেবলই মনে পড়ে সাতই মার্চের ভাষণের শেষাংশ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ রাজনৈতিক মুক্তি আমাদের অর্জিত হয়েছে। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছি। কিন্তু জাতির জনকের স্বপ্নের শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে আর তার ভালোবাসার হতদরিদ্র দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি আজও অর্জন করতে না পারলেও আমরা সেই লক্ষ্য পরিপূরণে এগিয়ে চলেছি। আন্তর্জাতিক জরিপকারী বিভিন্ন সংস্থার মতে, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি এক কথায় বিস্ময়কর। যদিও আমরা এখনও স্বল্পোন্নত, তথাপি আমরা জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমাদের আশাবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প’ অনুযায়ী ২০২১ সালে আমরা মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সরকার অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হবে।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য; বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

No comments

Powered by Blogger.