পাঠানকোটে ‘জায়শে মোহাম্মদের’ জঙ্গি হামলা by বদরুদ্দীন উমর

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে অমৈত্রীসুলভ সম্পর্ক, বলা যেতে পারে বৈরী সম্পর্ক, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়েছিল, তার অবসান আজ পর্যন্ত হয়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ‘বিভক্ত রাখো ও শাসন করো’ নীতির ভিত্তিতে যেভাবে উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত নিজেদের শাসন জারি রেখেছিল, সেই একই নীতির ভিত্তিতে তারা ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষার চক্রান্ত করেছিল। তাদের শেষ ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল মাউন্ট ব্যাটেন স্বাধীনতার মুহূর্তেই কাশ্মীর সমস্যা তৈরি করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাদের সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পর এভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন। পরে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বশক্তির নেতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখে এসেছে। ব্রিটিশ ভারতে সরকারের বিভেদ নীতির দ্বারা হিন্দু-মুসলমানরা যেভাবে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, সেভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে আজ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করছে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিরোধ ভারত-পাকিস্তান বিরোধে রূপান্তরিত হয়ে দুই দেশকেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে কাশ্মীর সমস্যা এই বিরোধের অপরিবর্তিত ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এ কারণে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি যাতে না হয়, তার জন্য এই সমস্যাকে অবলম্বন করে মাঝে মাঝেই এ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি ও সংঘর্ষ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এমনকি এ সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুটি পুরোদস্তুর যুদ্ধও হয়েছে। কাশ্মীর সমস্যা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সব সময় সামনে না এলেও এ সমস্যাই দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির শর্ত হিসেবে আজ পর্যন্ত জায়মান আছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কোনো উন্নতি যাতে না হয় তার প্রতি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা Inter Services Intelligence (ISI) সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আইএসআই-এর দ্বারা গঠিত কতগুলো সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সংগঠন এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে কাজ করে। সে কারণে বেসামরিকভাবে ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো একদিকে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে, নানা ধরনের ঘটনা ঘটায় এবং সামরিক বাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে মাঝে মাঝেই সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করে। অন্যদিকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research and Analysis Wing (RAW) ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ বা আরএসএস এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন সংঘ পরিবারের ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’, বজরং দল, শিবসেনা ইত্যাদি চরম সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে। ভারত সরকারও তাদের সাম্প্রদায়িক নীতি পরিকল্পিতভাবে অব্যাহত রাখে। এর ফলে পাকিস্তান ও ভারতের সাধারণ মানুষ এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের চেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয় না। কারণ সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার জন্য পাকিস্তান ও ভারতে কোনো সুসংগঠিত দল নেই। সংগঠিত কোনো প্রচেষ্টাই নেই। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর কার্যকলাপের জন্য যেখানে সুসংগঠিত দল আছে, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের জন্য কোনো সুসংগঠিত দল নেই। তাছাড়া যেসব সংগঠন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তারাও এ ক্ষেত্রে কোনো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে আন্দোলন করে না। কাজেই সাম্প্রদায়িক শক্তি তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। কংগ্রেস নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক বললেও ১৯৪৭ সাল থেকে সুযোগ-সুবিধা ও প্রশাসন ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক নীতি কার্যকর করে যাওয়ার ফলে তারা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষক হিসেবেই কাজ করে এসেছে। তাদের এই কাজের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই ভারতে আরএসএস তার শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং বিজেপি প্রথমে বাজপেয়ি ও পরে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছে। তারা আকাশ থেকে পড়েনি।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও কোনো কংগ্রেস সরকার নয়, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়িই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়বার এই চেষ্টা করছেন নরেন্দ্র মোদি। চরম সাম্প্রদায়িক হওয়া সত্ত্বেও ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তাগিদেই তারা কংগ্রেসের ঐতিহ্যের বাইরে বের হয়ে দুই দেশের পারস্পরিক বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও যা বিস্ময়কর তা হল, বিজেপির মাতৃসংগঠন আরএসএসই তাদের এই প্রচেষ্টা নস্যাতের ব্যবস্থা আগে করেছে এবং এখনও করছে। দেখা যায়, এ ধরনের চেষ্টা যখনই হয় তখন ভারত ও পাকিস্তানে এমন সব ঘটনা ঘটানো হয়, যার ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি না হয়ে তারা আগের জায়গাতেই ফিরে যায়। এমনকি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। লাহোরে বাজপেয়ির বাসযাত্রার পরই পাকিস্তানের আইএসএস ও সামরিক বাহিনী কাশ্মীরে বড় রকম সামরিক অভিযান চালিয়ে কারগিল দখল করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত তাদেরকে কারগিল থেকে বহিষ্কার করলেও দুই দেশের সম্পর্কের আর কোনো উন্নতি হয়নি।
কয়েকদিন আগে নরেন্দ্র মোদি তার বিদেশ সফর শেষে কাবুল থেকে দেশে ফেরার পথে হঠাৎ করে লাহোরে তার যাত্রাবিরতি করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাড়িতে গিয়ে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক কথাবার্তা হয়। যার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু এ সময় আরএসএস অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গার ওপর রামমন্দির নির্মাণের কর্মসূচি নতুন করে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়ে সেখানে পাথর জমানো শুরু করে। অন্যদিকে ৪ জানুয়ারি পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর স্থাপনার ওপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বেশ কয়েকজন সামরিক লোক নিহত হয় এবং বিমান ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা যে পাকিস্তানে অবস্থিত জায়শে মোহাম্মদের কাজ এতে এখন আর কারও সন্দেহ নেই। এই সংগঠনটি পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তিনি সামরিক বাহিনীর লোক হলেও ভারত-পাকিস্তান সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য বাজপেয়ির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার এই যে, দেশের প্রেসিডেন্টের কাছেও কোনো খবর ছিল না যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে কারগিলে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করেছে! পরে এ স্বীকারোক্তি পারভেজ মোশাররফ নিজেই করেছিলেন। কাজেই স্বয়ং প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারের বাইরেই ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রচেষ্টা বানচাল করা হয়েছিল। এসবের পেছনে কার হাত?
এবার নরেন্দ্র মোদির এই চেষ্টা শুরুর পরই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের এখতিয়ারের বাইরে আবার আইএসআই পাঠানকোটে বিমান ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে একইভাবে তা বানচালের চেষ্টা করছে। দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। ভারত পাকিস্তানকে তথ্য সরবরাহ করেছে এবং নওয়াজ শরিফ এই হামলার বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এর ফল কী দাঁড়াবে এবং নওয়াজ শরিফ ও নরেন্দ্র মোদি তাদের সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি-না অথবা কতদূর নিতে পারবেন- এটা এখন দেখার বিষয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.