ইলিশের স্বাদ কিসে হয় by আব্দুল কাইয়ুম

ইলিশ বাঁচিয়ে রাখতে হবে
একজন কৃষি প্রকৌশলী নিয়াজ পাশার একটি চিঠি আজ প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, বাজারে এখনো কেন ডিমসহ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ডিম পাড়া ইলিশ ধরার ওপর ১৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা পার হয়ে গেছে। তাও কেন ডিম পাওয়া যাচ্ছে। মাৎস্যবিজ্ঞানী এস এম নুরুল আমিনের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, এর কারণ হতে পারে এই যে পুরুষ ইলিশ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো স্ত্রী ইলিশে রূপান্তরিত হয়!
বিষয়টা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। বাজারে যত ইলিশ কিনি তার প্রায় সবগুলোই স্ত্রী ইলিশ, ডিম প্রায় সব মাছেই। এ রকম কেন? তাহলে কি পুরুষ ইলিশ সত্যিই স্ত্রী ইলিশ হয়ে যায়?
আমি ফোন করলাম ঠাটারীবাজারের ইলিশ মাছের ব্যবসায়ীকে। চণ্ডীদাস বর্মণ। কেরানীগঞ্জে স্থায়ী আবাস। ঠাটারীবাজারে ইলিশ মাছ বিক্রি করছেন ৩৬ বছর ধরে। জিজ্ঞেস করলাম, পুরুষ ইলিশ কি নেই? কেন নেই? তিনি বললেন, আছে, নিশ্চয়ই আছে। চাইলে দিতে পারি। তবে খুব কম পাওয়া যায়। তাহলে কম কেন? তিনি হেসে বললেন, এর কদর কম। জেলেরা পায়ও কম।
গতকাল সকালে তাঁর কাছ থেকে দুটি মাঝারি আকারের ইলিশ কিনলাম দেড় হাজার টাকায়। কাটার পর দেখা গেল দুটিতেই ডিম। চণ্ডীদাস বললেন, পুরুষ ইলিশের মাথাটা একটু ছড়ানো, শরীর চিকন ও লম্বা। মাছে কোনো স্বাদ নেই। বাজারে এর দামও কম। তাই মাছ ধরার সময় পুরুষ মাছ পেলে জেলেরা সেগুলো তখনই নদীতে ছেড়ে দেয়। দু-চারটা আড়তে আসে, দাম কম। ক্রেতা কম। তাই বাজারে সাধারণত পুরুষ ইলিশ পাওয়া যায় না।
ড. মো. আবদুল ওহাবের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ফিশে ইকো ফিশ প্রজেক্টে টিম লিডার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানালেন, ভেটকি, কোরালসহ অনেক মাছ বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় সিকোয়েনশিয়াল হারমাফ্রোডিজম। মালয়েশিয়ার শাড টেরুবোক প্রজাতির মাছ ইলিশের কাছাকাছি। এটিও বড় হলে স্ত্রী মাছে পরিণত হয়। তবে বাংলাদেশের ইলিশের ক্ষেত্রে এটা সত্য কি না, তা আরও খোঁজখবর নিয়ে জানতে হবে।
গতকাল তিনি ফোন করে জানালেন, আমাদের দেশে প্রতি দুটি স্ত্রী ইলিশের জন্য রয়েছে একটি পুরুষ ইলিশ। ইদানীং এই অনুপাত কমছে, তিন থেকে পাঁচটি স্ত্রী ইলিশের জন্য একটি পুরুষ ইলিশ। তিনি জানালেন, আমাদের দেশের স্ত্রী ইলিশ কখনো পুরুষ ইলিশে পরিণত হয় না।
কিন্তু ডিম নিয়ে এত আলোচনা কেন? কারণ, ডিমের সঙ্গে স্বাদের একটি সম্পর্ক আছে। ডিম আসার সঙ্গে সঙ্গে মাছের শরীর তেলে ভরে যায়। ওটাই স্বাদের উৎস। ডিম পাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সব পুষ্টি ডিমে সঞ্চিত হয়, মাছের স্বাদ কমে যায়। সব স্বাদ জমা হয় ডিমে। ডিম পাড়ার পরপরই ইলিশের স্বাদের ঘাটতি দেখা যায়। সে তো হবেই। সব স্বাদ তো ডিমেই চলে গেছে! তাই ইলিশ কিনতে গিয়ে আমরা বলি, ডিম ছাড়া ইলিশ আছে? তার মানে ডিম আসি-আসি করছে, সবে ডিম তৈরি হয়েছে বা ছোট আকারে রয়েছে। সেই মাছের স্বাদ অবর্ণনীয়। ও রকম একটি ইলিশ মাছ কুটে পানিতে ধুয়ে রাখতে গেলে আপনার হাত ইলিশের তেলে চকচকে ও পিচ্ছিল হয়ে যাবে। তখনই বুঝবেন ওই ইলিশ স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়, একেবারে ফাটাফাটি!
পুরুষ ইলিশে তো সেই তেলের ব্যাপার নেই। তাই পুরুষ ইলিশের কদর কম।
তাহলে পুরুষ ইলিশের দরকার কী? পুরুষ ইলিশ ছাড়া তো ডিম নিষিক্ত হবে না। ইলিশের বংশবৃদ্ধি হবে কীভাবে? ড. ওহাব বিষয়টি বিস্তৃতভাবে বললেন। মা ইলিশের পেটে ডিম যখন পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে, তখন সে তার শরীরের মাঝামাঝি অংশের আঁশের ফাঁক দিয়ে এক ধরনের সুগন্ধি হরমোন পানিতে ছড়িয়ে দেয়। তার গন্ধে পুরুষ ইলিশ ছুটে আসে। সে স্ত্রী ইলিশের পেট ও লেজের দিকে ঠোকর দেয়, গায়ে ঘষা দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মা ইলিশ পানিতে ডিম ছাড়ে। তখন পুরুষ ইলিশও পানিতে শুক্রাণু ছাড়ে। এভাবে ডিম নিষিক্ত হয়। এ সময় পুরো এলাকার পানি ঘোলা হয়ে ওঠে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে নদীতে ছড়িয়ে পড়ে।
ছোট ডিমসহ স্ত্রী ইলিশই সবচেয়ে স্বাদের। তাই বলে ওই সব মাছ ব্যাপক হারে ধরা যাবে না। ডিম পাড়ার মূল মৌসুমের সময়টুকু অবশ্যই ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু তার আগে-পরেও স্বাদে ভরপুর কিছু ইলিশ পাওয়া যাবে। বাজারে পাওয়া যায়। ওগুলোই সেরা ইলিশ।
তবে ইলিশের স্বাদ পেতে আরও কিছু দরকার। মাছ কতটা টাটকা, সে তো নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখতে হবে। আপনি বাজার থেকে ভালো, তেল চকচকে ইলিশ কিনে এনে অনেকক্ষণ রেখে দিলেন। যত সময় যাচ্ছে, মাছের স্বাদ তত কমছে। কারণ, মাছের প্রোটিনের সেলগুলো মরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর গুণ ও মান কমছে। মাছ ধরার সঙ্গে সঙ্গে বরফে বা ফ্রিজে রাখলে তার স্বাদ বেশি থাকে। আমরা অনেক সময় বলি, বরফ দেওয়া মাছ তো ভালো না। আসলে কথাটি ঠিক নয়। বরফ যদি ঠিকভাবে দেওয়া হয় এবং ‘কোল্ড চেইন’ রক্ষা করা হয়, তাহলে সেই মাছের স্বাদ অনেক বেশি হবে।
এরপর আসে রান্নার বিষয়। বাসায় রান্না করা যত ধরনের ইলিশ এ পর্যন্ত খেয়েছি, তার মধ্যে দুই পদের রান্না অতুলনীয় মনে হয়েছে। সবচেয়ে মজার রান্নাটি হলো—গুঁড়ো হলুদ-মরিচ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে কয়েক টুকরো ইলিশ মাখিয়ে লবণ, তেল ও সামান্য পানি দিয়ে ঢেকে চুলায় বসিয়ে দিন। মিনিট ১৫-২০। তারপরই সেরা স্বাদের রান্না ইলিশ। অপরটি হলো হলুদ-মরিচের গুঁড়ো মাখিয়ে তেলে ভেজে নিন। পরে পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ ভেজে ছড়িয়ে দিন। এর চেয়ে মজার ইলিশ-ভাজা আর হয় না। এটিও ১৫-২০ মিনিটে রান্না হয়ে যায়। আপনারা একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
পদ্মার ইলিশের তুলনা হয় না। তারও ওই একই কারণ। সাগর ছেড়ে ডিম পাড়ার জন্য ইলিশ পদ্মার স্রোতের বিপরীতে উজানে যেতে থাকে। এই সময় ডিম আসি-আসি করছে। ঠিক এই ইলিশই সবচেয়ে স্বাদের।
ইলিশ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ মাছ বাড়ছে। আরও বাড়বে, যদি আমরা সচেতন হই। জাটকা ধরা বন্ধ রাখি। ডিম পাড়ার ভরা মৌসুমে যদি অন্তত দুই সপ্তাহ ইলিশ ধরা বন্ধ রাখি। ইলিশ মাছ যখন দেখবে পদ্মা-মেঘনায় নিরাপদে ডিম পাড়া যায়, তখনই ওরা প্রতি মৌসুমে এখানে আরও বেশি আসবে। ঝাঁকে ঝাঁকে আসবে। ইলিশের জন্য আমাদের সবকিছু করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.