সঙ্কট সমাধানে সংলাপ শুরুর আহ্বান -অ্যালায়েন্সের উদ্বেগ

তৈরী পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, উত্তেজনাকর ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তাদের কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় যেসব পক্ষ একটি গতিশীল ও সফল বাংলাদেশ গড়তে চায় তাদের সহিংসতা পরিহার করে সঙ্কট সমাধানের জন্য সংলাপ শুরু করতে হবে। পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে- এমন বিশ্বের ২৬টি বড় ক্রেতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ সংগঠনটি শ্রমিকদের নানা সমস্যার কথাও তুলে ধরেছে। এ গ্রুপে যারা কাজ করছে তাদের বেশির ভাগই উত্তর আমেরিকার। সাত শতাধিক কারখানায় তাদের পোশাক তৈরি হয়। ১১ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে সংগঠনটির তরফে বলা হয়েছে, শ্রম আইনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখনও চূড়ান্ত করে নি বাংলাদেশ সরকার। ফলে এ আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। সম্প্রতি অ্যাকর্ডের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অ্যালায়েন্স আহ্বান জানিয়েছে ওই ধারাগুলো চূড়ান্ত করতে ও তা প্রচার করতে, যাতে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তা অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার মান উন্নত করার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যালায়েন্স। তারা এ খাতে শ্রমিকদের জন্য এমন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে শ্রমিকদের সম্মান দেয়া হবে এবং কারখানার মালিকদের প্রথম অগ্রাধিকার হবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা। অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির পরিচালনা পরিষদের স্বতন্ত্র চেয়ার ইলেন ও. তুশার বলেন, আমরা আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একই সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, কারখানা আধুনিকায়ন, তৈরী পোশাক খাতকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলাও আমাদের অব্যাহত লক্ষ্য। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লাখ লাখ মানুষকে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের পথ দেখিয়েছে পোশাকশিল্প। এটা শুধু তাদের উপার্জনের পথ দেখায় নি, একই সঙ্গে তাদের পরিবার ও দেশকে দিয়েছে অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুবিধা। এ খাতে নারী ও পুরুষ মিলে যে কাজ করছেন তাতে অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এসেছে বাংলাদেশে। দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার জন্য এ প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। নানা ট্র্যাজেডির ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে যে পরিবর্তন এসেছে তার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী তৈরী পোশাকশিল্পে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে গঠন করা হয় অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি (অ্যালায়েন্স)। তারা ওই প্রতিবেদনে বলেছে, অ্যালায়েন্স সদস্যরা যেসব গার্মেন্ট থেকে তাদের পোশাক তৈরি করে তার সবকটিতে অনুসন্ধান সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে নিরাপত্তার মান উন্নত করার ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে কি করণীয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে ১৯টি ঝুঁকি। অনুসন্ধানকারী প্যানেল ৫টি কারখানাকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার জন্য বাছাই করেছে। আংশিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ১২টি কারখানা। দুটি কারখানাকে কাজের চাপ কম নিয়ে সচল রাখতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ বছরের ১লা জানুয়ারি অ্যালায়েন্স আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব-অনুমোদন বিষয়ক একটি পলিসি চালু করেছে। এর অধীনে সব নতুন কারখানাকে নিবন্ধিত হতে হবে। তাতে অনুসন্ধান করা হবে। ভবন ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে। এ বছরের ৯ই জুলাইয়ের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ কারখানা চূড়ান্ত অনুসন্ধান করা হবে। তবে ২০১৭ সালের জুলাইয়ের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ কারখানা চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করা হবে। বাংলাদেশে কোন কোন কারখানা মালিক বা সরবরাহকারীর কারখানা মেরামতের মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। এ ক্ষেত্রে অ্যালায়েন্স সদস্যদের অনেকে একটি দ্বিপক্ষীয় আর্থিক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর অধীনে তারা স্বল্পসুদে আর্থিক সহায়তা দেবে সংশ্লিষ্টদের। এরই মধ্যে অনেক কারখানা এ খাত থেকে ঋণ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অ্যালায়েন্স একটি নতুন ঋণ সুবিধার সুযোগ সৃষ্টি করছে। স্থানীয় ৫টি ব্যাংকের মাধ্যমে অ্যালায়েন্স ২ থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার থাকবে একেবারেই অল্প। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানায় অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ও জরুরি ভিত্তিতে শ্রমিকদের সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিক, সুপারভাইজার, ম্যানেজার ও নিরাপত্তারক্ষীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য অ্যালায়েন্স বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-অস্টিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফল প্রকাশ করা হবে শিগগিরই। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশে শ্রম আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এতে সব কারখানাকে নাটকীয়ভাবে অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ কমিটি গঠন করতে হয়। এতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়েছে। ইলেন ওই প্রতিবেদনে বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো অ্যালায়েন্সভুক্ত সব কারখানায় কার্যকর ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এতে বলা হয়, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে চলেছে অ্যালায়েন্স। ইলেন বলেন, আমাদের কাজ অব্যাহত রয়েছে। অ্যালায়েন্স, অ্যাকর্ড ও জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনায় কাজের স্থিতিশীলতার জন্য আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছি বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
ওদিকে বিবিসি জানায়, বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ফোরাম অ্যালায়েন্স। সংগঠনটি বলছে, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ এখন থেমে গেছে। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, বিদেশী ক্রেতারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ সহায়তা না দেয়ায়, কারখানায় শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করার কাজে সমস্যা হচ্ছে। অ্যালায়েন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট রবিন মেসবাহ বলছিলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তাদের উদ্বেগের বিষয় বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, এ সময়সীমার মধ্যে যে পরিমাণ সংস্কার হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলাম, ততটা হয়নি। এটাই আমাদের উদ্বেগের কারণ। গত বছর ৫৮৭টি কারখানায় আমরা প্রাথমিক পরিদর্শন শেষ করি। যেসব ঘাটতি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়েছিল, তার মধ্যে সংস্কার কাজের জন্য সময়সীমা দেড় মাস থেকে শুরু করে নয় মাস পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। সেখানের মধ্যে ১২৪টি কারখানায় আমরা আবার পরিদর্শন করেছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২৪ শতাংস সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম এ সময়ের মধ্যে ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হবে। তবে তা হয়নি। অন্যদিকে বিজেএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেছেন, অনেক কারখানায় ছোট সমস্যা বা ত্রুটিগুলো সারিয়ে ফেলা হয়েছে। বড় ধরনের ত্রুটি বা সমস্যা সমাধানের কাজ বন্ধ রয়েছে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদেশী ক্রেতারা এখনও অর্থ সহায়তা না দেয়ায়।

No comments

Powered by Blogger.