পোড়া শরীরেই চলে গেল ফুটফুটে মরিয়ম

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৪৩ জন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাদের পোড়া ক্ষতগুলোর কোনো একটি স্থান একটু শুকাতে না শুকাতেই অন্য স্থানগুলো পচে উঠছে। টান পড়ছে চামড়া, কুঁচকে যাচ্ছে হাত-পা। এ অবস্থায় দগ্ধদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের মধ্যে ভয়-আতংকের সৃষ্টি হচ্ছে। সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের কাউকে কাউকে মুহূর্তেই আইসিইউতে নিতে হচ্ছে। বর্তমানে আইসিইউতে ৫ জনসহ পুরো ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন ৪৩ রোগী। ইতিমধ্যে চিকিৎসাধীন ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে শিশু মরিয়ম (৬)।
দগ্ধদের কোনো অবস্থাতেই আশংকামুক্ত বলা যায় না জানিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, বেশির ভাগের শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাদের বাঁচা এখন অনিশ্চয়তায়। কোনো কোনো রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পরও মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে ট্রাক হেলপার মাসুদ মিয়াকে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। বুধবার দুপুরে আইসিইউতে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলেন শাপলা। কখনও আবার দৌড়ঝাঁপ করছিলেন এদিক-ওদিক। বারান্দায় কোনো ডাক্তার পেলেই অসহায় কণ্ঠে বলছেন, ‘স্যার যেমনে পারেন আমার স্বামীকে বাঁচান, আমার ভাইও এখানে (আইসিইউ) ঢুকার পর, অনেকদিন সেবা পেয়েও মারা গেছে।’
শাপলা জানান, ২৩ জানুয়ারি বগুড়া চারমাথা এলাকায় ট্রাকে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন স্বামী মাসুদ মিয়া ও তার আপন ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম। ভোরে দু’জনকেই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ওই দিনই ভাই জাহাঙ্গীর আলমকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছিল। আর তার স্বামীকে ভর্তি করানো হয় এইচডিইউ ইউনিটে। স্বামী এখনও বেঁচে রয়েছে উল্লেখ করে জানান, ২৭ ফেব্রুয়ারি তার ভাই আইসিইউতে মারা যান। এখন তার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে। বার্ন প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন বিভাগ প্রধান প্রফেসর ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার জানান, মাসুদ সুস্থ হয়ে উঠছিল, কিন্তু তার শ্বাসনালি পোড়া থাকায় দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। মাসুদসহ আইসিইউতে থাকা বাকি ৪ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা দিন-রাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে। হকার শফিকুল ইসলামকেও আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। শফিকুল ৩ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন। তিনি কক্সবাজার সৈকতের পাড়ে ফেরি করে মুড়ি-চানাচুর বিক্রি করতেন।
বার্ন ইউনিট প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম জানান, বর্তমানে দগ্ধ রোগীদের অপারেশন করা হচ্ছে বেশি। যাদের চামড়া টান পড়ছে তাদের অপারেশন কয়েকদিন পরপরই করতে হচ্ছে। অনেকের শরীর পুরোটা পুড়ে যাওয়ায় চামড়া কেটে চামড়া প্রতিস্থাপনও করা যাচ্ছে না।
বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, রোগীরা যতক্ষণ না সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকেই আশংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না।
মারা গেছে শিশু মরিয়ম : বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিশু মরিয়ম। শিশু মরিয়ম ৪ ফেব্রুয়ারি অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়। ভর্তির দিন থেকেই মরিয়ম আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল। শিশু মরিয়ম পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগী হিসেবেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ হয়, শিশু মরিয়ম পেট্রলবোমায় নয়, গ্যাসের চুলায় দগ্ধ হয়। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মরিয়ম পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে এমনটাই জেনে চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাওয়া ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্রও মরিয়মের নামে করা হয়। মরিয়মের মা নার্গিস আক্তার শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, তিনি গার্মেন্টে চাকরি করেন। ময়িরম যে সময় দগ্ধ হয়, সে সময় তিনি গার্মেন্টে ছিলেন। রাত ১০টার দিকে সংবাদ পেয়ে তিনি গাজীপুর মেডিকেলে যান। তার কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্সে করে মরিয়মসহ আরও পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৩ জনকে ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। মা নার্গিস আক্তার জানান, শিশু মরিয়ম তার মায়ের (নানির) সঙ্গে বাসে করে খালার বাড়িতে যাচ্ছিল। ওই বাসেই পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়।
বার্ন ইউনিটের প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন, প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ ও প্রফেসর ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার জানিয়েছেন, মরিয়ম এতদিন পেট্রলবোমায় দগ্ধ হিসেবেই চিকিৎসাধীন ছিল।
আমাদের গাজীপুর যুগান্তর প্রতিনিধি মো. আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, মরিয়ম গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বরুদা এলাকায় একটি বাসায় গ্যাসের চুলার আগুনে দগ্ধ হলেও ৪ ফেব্র“য়ারি একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার হয়। পরে মরিয়মের খালু আবুল কালামের কাছ থেকে জানা যায়, মরিয়ম পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়নি, গ্যাসের চুলার আগুনে দগ্ধ হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.