পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিস্তার পানি by মিজানুর রহমান খান

ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে অন্তত আলোচনায় টিকে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা নিয়ে মুখ খুলেছেন। তবে রংপুরে তিস্তা আরও শুকাচ্ছে। সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বললেন, ২০ মার্চ তাঁরা ৫০০ কিউসেক পানি মেপেছেন। সেখানে থাকার কথা কমপক্ষে তিন হাজার কিউসেক। ঢের সময় বাদে তিস্তার পানিবণ্টন প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খবরের শিরোনাম হতে দেখা গেল। ভারতে নির্বাচন কড়া নাড়ছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু কলকাতায় তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে সরাসরি মমতাকে অভিযুক্ত করেন। বামদের এমন অকপট অবস্থানও নতুন। বিমান বসু যথার্থই বললেন, ‘তিস্তা ও ছিটমহল চুক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালেই হতে পারত। মমতা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে বাংলাদেশের ভারতবিরোধী মৌলবাদীদের উৎসাহ জুগিয়েছেন।’

২০ মার্চ আউটলুক পত্রিকার শিরোনাম ইঙ্গিত দিচ্ছে, মমতা হয়তো নির্বাচন ঘিরে নতুন করে বাংলাদেশবিরোধী তিস্তা কার্ড খেলবেন। তাঁর অভিযোগ পানি মন্ত্রণালয় কংগ্রেসকে দিয়েছিলাম। তাই টের পাইনি। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের ঘরে সিঁধ কেটেছে। ফারাক্কার ফটক ভেঙে তিন মাস পানি দিয়েছে বাংলাদেশকে। ভাগীরথীর পানিও গোপনে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ সেচসংকটে পড়ছে। খাবার পানিরও সংকটে পড়ছে মানুষ। তাঁর বিজয়ের দিনে সেই যে তাঁর কালীঘাটের বাসভবনে সামান্য কথা হলো, তার পরে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁর বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব ছড়াল। এরপর তাঁর মুখে আর বাংলাদেশবান্ধব কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
সেচমন্ত্রী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি মানস ভুনিয়া। তিনি ইস্তফা দেন দুই বছরের বেশি সময় আগে। ওই সময় ভুনিয়া বলেছিলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে দুই হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এর মধ্যেই রয়েছে ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন, যা পানি ধরে রাখবে। এর ভাগ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ড্যাম বিষয় বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ নিরাজ ভাগোলিকার ২০১২ সালে লিখেছেন, ‘মূল তিস্তার প্রবাহ সিকিমে ইতিমধ্যে বেশ দমে গেছে। এখন যদি তিস্তার প্রস্তাবিত চতুর্থ প্রকল্পেরও বাস্তবায়ন ঘটে, তাহলে তা হবে তিস্তার কফিনে শেষ পেরেক (ইনডিপেনডেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল অন ড্যামস, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডিসপ্লেসমেন্ট, পৃ. ২১৯)। আমাদের কেউ বলছে না যে তিস্তার উজানে আরও কত কী ঘটে চলেছে। বলা বাহুল্য, ভারতে তিস্তাকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকারই করা হয় না।
ড. ক্রিস্টোফার জ্যাসপারো ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। কাতারে মার্কিন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন সার্ভিস স্কুলের সহযোগী ডিন ড্যানিয়েল সি স্টল এবং ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট জি উইরসিং ২০১২ সালে বই বের করেন। এতে তাঁরা বলেন, তিস্তার পানিভাগে এতটাই বিপরীতমুখী সূত্র আছে, যা এখন তাঁদের কথায় ‘ব্লানটলি এক্সপোজড গ্যাপ’। তাঁরাও এও বলেন, ‘সেসব আবিষ্কারের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’ টিপাইমুখে আমাদের বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ওই গবেষকেরা দেখান, কেবল ছোট্ট সিকিমেই ২৯টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণাধীন কিংবা পরিকল্পনাধীন আছে। (ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট ওভার ওয়াটার রিসোর্সেস ইন হিমালয়ান এশিয়া, পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, পৃ. ৭৯) সুতরাং তিস্তাচিত্র ধূসর।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ‘পানি পাচারের’ একটি বাসি অভিযোগ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে মমতা এবার বলেছেন, ‘তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নন। আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমি শুধু কেন্দ্রের ভূমিকার কথা বলছি। যদি রাজ্যের সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানি দেওয়া হয়, তাহলে আমার আপত্তি নেই।’ মমতার এটা নীতি বদলের ইঙ্গিত হলে মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ হওয়ার কথা। কিন্তু তেমন আলামত নজরে এল না।
গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে মমতা তিস্তা কার্ড খেলে সুফল পেয়েছিলেন। জলাপাইগুড়ির তৃণমূল এমএলএ খগেশ্বর রায় বলেছিলেন, ‘যখন আমরা গ্রামের লোকদের বলি আমাদের নেত্রী তিস্তার পানিভাগ প্রশ্নে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে চলেছেন, তখন তাঁরা নেত্রীর প্রশংসা করেন (দ্য টেলিগ্রাফ, ১৮ জুলাই ২০১৩)।’ আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি অমর সাহা একমত হন যে নির্বাচন সামনে রেখে কথাবার্তা যেটুকু যা হচ্ছে, বাস্তবে তিস্তা প্রশ্নে কোনো দলের অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন নেই।
মমতা মুর্শিদাবাদের সভায় অবশ্য বলে দিয়েছেন, রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রকে সম্মত হতে হবে। তবে আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও বিরোধী দলের সর্বশেষ প্রকাশ্য ‘ইতিবাচক’ মনোভাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সমুদ্রভাগের সূত্রে অগ্রসর হতে পারে। অনেকের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে উপমহাদেশ নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। শেখ হাসিনা পঁচাত্তর পূর্বকালের নিষ্ফল দ্বিপক্ষীয় সমুদ্র আলোচনার সীমাবদ্ধতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। তিনি বিষয়টি বিচক্ষণতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলেছেন। জাতি তার সুফল পেয়েছে। ঢাকা-দিল্লি বন্ধুত্বের যে চেতনা এখন জাগরূক রয়েছে, তার আলোকে তিস্তার পানিভাগ প্রশ্নে বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতকে মৌখিকভাবে হলেও একটি সালিসির প্রস্তাব দেওয়া। এমন তো নয় যে, সালিসির প্রস্তাব দিলেই তা থেকে আর দ্বিপক্ষীয় টেবিলে ফেরা যাবে না। দুটো দিকই একসঙ্গে খোলা থাকবে। উভয় পক্ষ সতর্ক ও আন্তরিক থাকলে একটি অন্যটিকে বাধাগ্রস্ত করবে না। যেদিকে ঝুঁকলে সাফল্য আসবে, সেদিকেই উভয়ে ঝুঁকবে। কারও মনে কোনো মালিন্য থাকবে না।
কংগ্রেস বা কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য বন্ধুরা সিঁধ কেটে আমাদের পানি দেবে, অমন পানি সত্যি কখনো আমাদের চাই না। গঙ্গা চুক্তির ১৭ বছর পার হয়েছে বটে। কিন্তু বৈধ চুক্তি থাকতেও ফারাক্কার গেট ভেঙে পানি দেওয়ার গল্প কেন সাজাতে হবে, তা বোধগম্য নয়। তবে এমন দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত আমাদের সন্দিগ্ধ করতে পারে যে ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষে কি সহজেই তা নবায়ন হবে? তখন ভারতের রাজ্যে এবং কেন্দ্রে উভয় স্থানের রাজনীতিতে কোয়ালিশন সরকার আরও জটিল কিংবা বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ ধারণ করতে পারে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, রাজ্যের সম্মতিতে পানিভাগ চুক্তি করতে হবে। তার মানে কি এই যে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও রাজ্যকে উপেক্ষা করতে পারবে না? প্রশ্নটি কি কেবলই রাজনৈতিক? ভারতের সংবিধান ও আইন কী বলে? রাজ্যের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্র নদীবিষয়ক সিদ্ধান্ত যদি না-ই নিতে পারে, তাহলে তো তাদের যে নদী অনেকগুলো রাজ্যকে অতিক্রম করে গেছে, সে বিষয়ে কোনো ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত সোনার হরিণ হয়ে থাকার কথা। কিন্তু সে ধরনের অচলাবস্থা তো হচ্ছে না। পানিভাগ নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে মনোমালিন্য আছে, আন্তর্জাতিকসহ ভারতের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নদী একাধিক রাজ্যের মধ্য দিয়ে গড়িয়েছে। কিন্তু ভারত থেমে নেই। ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশীকে পানির হিস্যা দিতে ভারত তাহলে থমকে আছে কেন।
ভারতের সংবিধানে পানি রাজ্যের বিষয়। কিন্তু সাংসদদের একটি সর্বদলীয় কমিটি ২০১২ সালের জুলাইয়ে অসাধ্য সাধন করেছে। তারা এক সুরে বলেছে, পানিকে আর শুধু রাজ্যের বিষয় হিসেবে রাখা যাবে না। তবে এটা পাস করা সহজ হবে না। কারণ অনেক রাজ্য বিরোধিতা করবেই। তবে এ ক্ষমতা পেলে তারা তখন সেই বিতর্কিত আন্তনদীসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরাট এখতিয়ার পাবে। কারণ, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অববাহিকাভিত্তিক পানি ভাগাভাগি, আন্তর্জাতিক নদী এবং তার পানির হিস্যা লাভের ধারণাগুলো প্রতিবেশীদের প্রতিকূলে যথেষ্ট বদলে যেতে পারে।
তবে পানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির বিষয়টি নিশ্চিত হয়, তবে হয়তো তিস্তা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক বেশি বলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি খুব বদলাবে, তা মনে হয় না। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ আট হাজার ও ভারত ২১ হাজার কিউসেক পানি দাবি করেছে। মুহাম্মদ ইনামুল হক ২০ মার্চ ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দুই দেশের দাবি সব মিলিয়ে ২৯ হাজার কিউসেক হলেও শুকনো মৌসুমে তিস্তার যে সর্বনিম্নপ্রবাহ, তা কোনোভাবেই ১০ হাজার কিউসেকের বেশি হতে পারে না।
তাই তিস্তা ভাগ এখন ঈষৎ মমতাময় মনে হলেও ভোটের পরে এটা উবে যেতে পারে। তাই বলতে চাই, সমুদ্রভাগের মতো হোক না নদীভাগ, আজই সিদ্ধান্ত না হোক, আপাতত অন্তত চায়ের কাপে ঝড়টা উঠুক।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.