স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

স্বাধীনতা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিশেষ নিয়ামত; স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। আল্লাহ তাআলা মানুষকে স্বাধীনভাবে বিচরণের অধিকার দিয়েছেন, নিয়ামতের ভান্ডার উন্মুক্ত করেছেন এবং জ্ঞান ও অধিকার বরাদ্দ করেছেন। যারা এসব কাজে লাগিয়ে বিশ্বকে জয় করার সংগ্রাম-সাধনা করে, স্বাধীনতা তাদেরই জন্য। স্বভাবগতভাবেই মানুষ স্বাধীনচেতা জীব। সে পরাধীন বা অন্যের অধীনে থাকতে চায় না। প্রয়োজনে স্বাধীনতার জন্য সে নিজের জীবনও বিসর্জন দেয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানবসন্তান প্রকৃতি বা ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ (মিশকাত) প্রত্যেক মানুষই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চায়, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে চায়। স্বাধীনতাই মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সহায়তা করে। এ চিরন্তন সত্য উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুগে যুগে অনেক জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ-সংগ্রাম করেছে। মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন থাকতে চায় না। ইসলামও এমন পরাধীনতা সমর্থন করে না। পরাধীনেরা তাদের স্বীয় মাতৃভূমি উদ্ধার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে—এটাই ইসলামের বিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মদিনায় হিজরত করে একটি স্বাধীন ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিতকে মজবুত করার নিমিত্তে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন,
যা ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নিয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের মহতী লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি এ সমঝোতা সনদ প্রণয়ন করেন। একটি স্বাধীন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান, যাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া চিন্তা ও মতামত প্রকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান করে মহানবী (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। আরব দেশে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ নানা দিক বিবেচনা করে প্রণীত সনদে মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মাবলম্বীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ছিল। এভাবে মদিনায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সবার ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হয়েছিল। ফলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। নবী করিম (সা.) মদিনা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এমনকি অনেক আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত অধিকারবঞ্চিত মানুষের স্বাধীনতার জন্য জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন ও সংগ্রাম করাকে তিনি শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি, বরং সার্বভৌমত্ব অর্জন ও দেশ রক্ষায় জীবনদানকে শহীদের সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও আক্রমণ প্রতিহত করে কার্যত বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, বিনা ধ্বংসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তিনি জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকদের কবল থেকে মক্কাকে স্বাধীন করলেন।
মক্কাবাসী কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েও মক্কা বিজয়ের পর আজাদির সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে তিনি পরাজিত সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘হে আমার দেশবাসী! তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই। তোমরা মুক্ত, স্বাধীন।’ স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার অনুপম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন স্থাপন করেন। অতঃপর সামান্য সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্রের পরিধিকে বিস্তৃত করে পুরো আরব ভূখণ্ডকে অবারিত শান্তি ও নিরাপত্তায়, অভূতপূর্ব শৃঙ্খলায়, অপূর্ব সুষম বণ্টনে, অবর্ণনীয় ভ্রাতৃত্ববোধে ও স্বপ্নাতীত জনকল্যাণে ভরে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সব বিষয়কে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। ফলে সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক জনগণই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে থাকে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা পেতে থাকে। স্বাধীনতার সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পরাধীনতা আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা। যে স্বাধীনতার জন্য শোকর আদায় করে শেষ করা যায় না। যাঁদের সুমহান আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের বিনিময়ে আমরা মাতৃভূমির স্বাধীনতা লাভ করেছি, যাঁদের অশেষ অবদানে বাঙালি জাতি গৌরব অনুভব করে, আমরা কখনোই তাঁদের ভুলতে পারি না। তাই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার মর্যাদা সমুন্নত রাখা আমাদের ইমানি দায়িত্ব এবং পবিত্র কর্তব্য। স্বাধীনতা সুরক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য ও জনসংহতি খুবই প্রয়োজন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ার লক্ষ্যে উন্নয়নের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অর্থবহ করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.