ক্রিকেট: মা, তোর বদনখানি মলিন হলে...

খুব মন খারাপ করে শেরেবাংলা স্টেডিয়াম থেকে ফিরছিলাম। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। রাতের অন্ধকার চিরে গাড়ি করে বাড়ি ফিরছি। হাতে একটা পতাকা-স্ট্যান্ড। সেটা কামড়াচ্ছি। নানা কথা মনে হচ্ছে। আমরা কেন এত ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছি? আমরা কেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে এত সমর্থন দিই? কেন দল হারলে আমরা মুষড়ে পড়ি। ভেবে ভেবে বের করি, ক্রিকেটাররা আমাদের বেশ কিছু জয় দিয়েছেন। আমরা জানি, আমাদের ফুটবল দল বিশ্বকাপের ফাইনাল রাউন্ডে খেলবে না। আমরা আসলে জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন স্তরে মার খেতে খেতে জয়ের জন্য তৃষিত হয়ে আছি; কেউ যদি কোথাও আমাদের একটু জয় এনে দেয়! আমরা বিজয়ীর সঙ্গে থাকতে চাই। যেহেতু নিজের জীবনে জয় নেই, জাতীয় জীবনেও জয় নেই, তাই আমরা আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলকে আঁকড়ে ধরি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি আমাদের জয় এনে দেবে, এই আশায় বিশ্বকাপ ফুটবলে আমরা মাতোয়ারা হয়ে থাকি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরে গেছে, আমাদের ভীষণ রাগ, ভীষণ হতাশা! কেন তোরা আমাদের জয় এনে দিতে পারিস না? না পারলে খেলতে যাস কেন? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটা কথা বলেন। সক্রেটিসকে প্লেটো জিজ্ঞেস করেছিলেন, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম কী? সক্রেটিস জবাব দিয়েছিলেন, সবচেয়ে ভালোভাবে নিজের কাজটুকুন করা। সাকিব বা তামিমকে দোষ দেওয়ার আগে আমি আমার নিজের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করি, তুমি কি তোমার কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করছ? তুমি কি এমন কিছু করেছ, যাতে দেশের মুখোজ্জ্বল হয়? দেশের উপকার হয়?
এই প্রশ্ন আজ আমাদের প্রত্যেককে করতে হবে। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বেশির ভাগ নাগরিকই দেশের জন্য এমন কিছু করে না, যা নিয়ে গর্ব করা যায়। আমরা বিদেশে যাওয়ার সময় ডলার নিয়ে যাই, আর কাঁড়ি কাঁড়ি শপিং করে আনি। আমরা বিদেশে নাগরিকত্ব নিই, দেশের ফ্ল্যাট, জমিজমা বিক্রি করে হুন্ডি করে টাকা নিয়ে বিদেশে স্থায়ী হই। আর দুর্নীতি করি, দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাঠাই। আমরা আমাদের বন-নদী-জমি ধ্বংস করি। উপকার যদি দেশের কিছু হয়ে থাকে, তা করছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা, যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডলার আয় করেন আর তা দেশে পাঠান। করছেন আমাদের গার্মেন্টস-শ্রমিকেরা, শরীরের রক্ত পানি করে তাঁরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা দিচ্ছেন। আমাদের জন্য করছেন কৃষকেরা, ১৬ কোটি মানুষকে অন্ন জোগাচ্ছেন। আর আমরা তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দুর্নীতি করি। দুর্নীতিপোষক ব্যবস্থাকে কায়েম রাখি আর তার ননি-মাখন তুলে তুলে খাই। আর টেলিভিশনের সামনে বসে মন্তব্য করি, খেলতে পারিস না, খেলতে যাস কেন? অন্যের সমালোচনা করার আগে নিজের চেহারাটা যেন আমরা আয়নায় দেখে নিই। আমি এমন কী করেছি যা বিশ্বসভায় আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল হতে খানিকটা সাহায্য করেছে? আমার চেয়ে ঢের ভালো ভেড়ামারার রাসেল আহমেদ, যিনি ওই গ্রামে বসে আউটসোর্সিং করছেন, মাসে মাসে ডলার আনছেন, যাঁর সঙ্গে কাজ করছে গ্রামের হাজার যুবক। বিনা পয়সায় স্কুলে পড়েছি, কলেজে পড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি আর দেশের টাকা বাইরে পাচার করছি। দেশের জল-মাটি-বনানী ধ্বংস করছি।
আমি আবারও বলি, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হলো সবচেয়ে ভালোভাবে নিজের কাজ করা। একটা কথা প্রচলিত আছে, খালি মুরগি কেনার বেলায় আমরা দেশপ্রেম দেখাই, আমরা দেশি মুরগি খুঁজি; তবে আমার মনে হচ্ছে, শুধু মুরগি কেনার বেলায় নয়, আমরা ক্রিকেট দেখার সময় দেশপ্রেমিক হয়ে যাই। এটা সাকিব বা তামিমের দোষ নয় যে তারাই আমাদের দেশের সেরা খেলোয়াড়! আমাদের গরিব দেশ। আমরা মারকুটে স্বভাবের নই। আমরা পররাজ্যে হামলা করিনি। উপনিবেশ স্থাপন করিনি। এখানে ১৭ জন ঘোড়সওয়ার এসে রাজ্য দখল করে নিয়েছে, এখানে কয়েকজন বণিক বাণিজ্য করতে এসে দুই শ বছর শাসন করেছে। আমরা আকারে ছোটখাটো, মনটা মায়ায় ভরা, এখানে কবি আছে, যোদ্ধা কম। কেবল ১৯৭১ সালেই আমরা জেগে উঠেছিলাম বিপুল বিক্রম নিয়ে। ক্রিকেট শারীরিক সক্ষমতারও খেলা। আমরা অপুষ্টির শিকার। শৈশব আমাদের কাটে দারিদ্র্যে, তারপর টাকার মুখ দেখলেই আমরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ি। তবু আশার কথা যে শচীন টেন্ডুলকার কিংবা ম্যারাডোনা-মেসি কেউ লম্বা নন। কেবল শারীরিক বল দিয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল হয় না। খেলায় ভালো করার জন্য লাগে প্রতিভা, প্রশিক্ষণ, নিরলস সাধনা, জিগীষা, মানসিক দৃঢ়তা, খেলোয়াড় তৈরির অবকাঠামো ও ব্যবস্থা, অনুকূল পৃষ্ঠপোষকতা, নেতৃত্ব, প্রতিজ্ঞা, সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, দূরদর্শী পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব। তবে আমাদের টিমের অবস্থা এখন বোধ করি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নানা ফর্মে একটা খেলাতেও জিতিনি, এশিয়া কাপেও হোয়াইটওয়াশ হয়েছি, এমনকি আফগানিস্তানের কাছেও হেরেছি খারাপভাবে। টি-টোয়েন্টি প্রথম পর্বে হংকংয়ের কাছে খেলার দিনও কি প্রত্যাশার চাপ ছিল? এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই করতে পারি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলার দিন মনে হয়েছে, সাকিব কেন তিন ওভার বল করবেন, সোহাগ গাজী কেন চার ওভার। আরেকটা প্রশ্নও আছে, ধরলাম, আমরা খেলতে পারি না, আমাদের সক্ষমতাই নেই। কিন্তু আমরা পিচও কেন আমাদের মতো করে বানাতে পারি না? পিচ কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য সহায়ক হয়? এখন একটু ভাবি, যাঁরা বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে সমর্থন দেন তাঁদের কথা। সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, দুঃসময়ে হায় হায় কেউ কারও নয়। মঙ্গলবারে বাংলাদেশ জিতলে আমি বলতাম, আমার জন্যই জিতেছে। আমি যে গ্র্যান্ড-স্ট্যান্ডে বসে ছিলাম। হারার সময়ও অবশ্য বলছি, অনেকেই বলছেন, দূর আমি গেলেই হারে। বা আমি অমুক শার্ট পরলে হারে। এই সব কোনো অজুহাত মাত্র নয়। আপনি-আমি তো আর মাঠের মধ্যখানে গিয়ে ব্যাট বা বল করে দিয়ে আসতে পারব না। সমালোচনা করতে পারব, সেটা তো আমরা পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, রোনালদোরও করি। কাজেই এখন ১৬ কোটি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের পরামর্শের ঝড় বয়ে যাবে। বিশেষ করে আমার মতো নিধিরাম সর্দারদের তো আছেই ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার। আমরা তো বলবই—মুশফিকের খেলা দেখলে মনে হয়, এই একটা ছেলেরই মাত্র দায়িত্ব দলটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া।
আর কারও কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এটা কেন মনে হয়। মুশফিক যদি ধরে খেলতে পারেন, অন্যরা কেন পারেন না? যা-ই হোক, এর চেয়েও খারাপভাবে মিরপুর থেকে ফিরে এসেছিলাম। গত বিশ্বকাপের আসরে, ৪ মার্চ ২০১১। ৫৮ রান নিয়ে। এবার তো তবু ৯৮। তারপর পরের খেলায় আমরা জিতেছিলাম। ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিলাম। পরে এশিয়া কাপে ভালো করেছিলাম। আমাদের এগোতেই হবে। আমরা আবার আশায় আশায় বুক বাঁধব। বাংলাদেশের ক্রিকেট-ভক্তরা পৃথিবীর সেরা। তাদের দল চ্যাম্পিয়ন নয়, কিন্তু তাতে দলের প্রতি তাদের ভালোবাসা কমে না। সামাজিক মাধ্যমগুলোতেই তো আওয়াজ উঠেছে, আমরা দলের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব। হারুক জিতুক। আর ‘চার-ছক্কা হইহই’ গানটা নিয়ে যতগুলো ফ্ল্যাশ মব হয়েছে, তা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমে পর্যন্ত লেখালেখি হচ্ছে। একক একটা গান নিয়ে এর আগে এত ফ্ল্যাশ মব আর হয়নি বলেই শোনা যাচ্ছে। নিউইয়র্ক থেকে কাতার, টরন্টো থেকে প্যারিস, লন্ডন থেকে সিডনি, নোয়াখালী থেকে রংপুর, বিয়েবাড়ি থেকে সুপার মল—সর্বত্রই হচ্ছে ফ্ল্যাশ মব, হঠাৎ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে একটা গানের তালে নাচ। সেটাও তো ক্রিকেটের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসারই প্রতিফলন। আমাদের টিমের দরকার তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। আমরা পারব। আমরা তো অতীতে পেরেছি।
গত এশিয়া কাপেই আমরা ভারতকে হারিয়েছি। বিশ্বকাপে আমরা ভারতকে হারিয়েছি। আবারও পারব। আর দরকার দলের মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য। আমাদের টিমটা যেন সব সদস্য মিলে এক দেহ, এক মন হয়ে ওঠে। এই সব বিষয়ে কাজ করতে হবে কাউন্সেলরদের, থিঙ্কট্যাংককে। ক্রিকেট মনেরও খেলা। মনের খেলায় যেন আমরা না হারি। বনের বাঘ আসার আগে যেন মনের বাঘে আমাদের না খেয়ে ফেলে। আমাদের ক্রিকেটাররা স্বাধীনতা দিবসে লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে মিলে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন। সেই ছবি দেখে খুব ভালো লাগল। জাতীয় সংগীতে একটা লাইন আছে, ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।’ সুমনা শারমীন, আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক, একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। তাঁরা কয়েকজন নারী সাংবাদিক গেছেন আমেরিকায়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরা বলল, এই, তোমরা গান গেয়ে শোনাও একটা। সবাই জানেন, এমন গান কী আছে? মেয়েরা গাইতে শুরু করলেন জাতীয় সংগীত। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ গাইতে গিয়ে প্রত্যেকের চোখে জল গড়াতে লাগল, তাঁরা হাউমাউ করে কাঁদছেন আর গাইছেন। আমেরিকানরা অবাক। তোমরা কাঁদো কেন?
আমরা যে জাতীয় সংগীত গাইছি!
জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে বুঝি মানুষ কাঁদে? কই, আমরা তো কাঁদি না?
তোমরা এটা বুঝবে না। আমাদের দেশ নিয়ে, আমাদের পতাকা নিয়ে, আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে আমাদের কী যে আবেগ, কী যে বেদনা, কী যে ভালোবাসা, বাইরের মানুষকে আমরা তা বোঝাতে পারব না। আমাদের ক্রিকেটাররাও নিশ্চয়ই সেটা খুব ভালো করে জানে। তারাও তো এটা উপলব্ধি করে, তাদের জীবনেও এটা সত্য হয়ে ওঠে—‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।’ গত এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে দুই রানে হারার পরে সাকিবের কোলে মুশফিকের মাথা, সাকিবের চোখে জল টলমল করছে, এই দৃশ্য আমরা ভুলব না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে বিশ্বকাপে চট্টগ্রামে জেতার পরেও সাকিবের চোখ জল চিকচিক করছিল। প্রিয় ক্রিকেটারগণ, তোমরা হারো জেতো, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। তবে তোমরা সবচেয়ে ভালোভাবে নিজের কাজটুকু করছ, সে জন্য যতটা পরিশ্রম, সাধনা, আত্মত্যাগ দরকার, তোমরা তা স্বীকার করছ, আমরা তা বিশ্বাস করি। একইভাবে আমার কর্তব্য হলো সবচেয়ে সুন্দরভাবে নিজের কাজটুকু করা। নিজের কাজে ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেটারদের সমালোচনা করাটা বোধ হয় ততটা কাজের কাজ হবে না।
জয় বাংলাদেশের হবেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.