বাংলাদেশে কর আহরণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

এবারের জাতীয় আয়কর দিবস উদযাপনকালে এটা জানা বেশ প্রশান্তিদায়ক যে, আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আনন্দদায়ক যে, আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতা বান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ সাফল্য আসছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাস, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি, পদ্ধতি সহজীকরণ, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। গত পাঁচ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকায় এসেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮,৪৫৫ কোটি টাকা আর ২০১১-১৩ তে তা ৫০,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে অধিক পরিমাণে শুল্ক ও কর রাজস্ব আহরণের একটা অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, এ পাঁচ অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে এবং সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে রয়েছে। তবে বলে রাখা ভালো, এখনও আয়কর কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিবারে তৃতীয় শরিক, অর্থনীতির আকার, অবয়ব, চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুল্ক (আশু) ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকে আয়করের অবস্থান এক নম্বর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে অধিক পরিমাণে মূসক হিস্যা এখনও শতকরা ৩৭ আর আশু ৩৩। সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়করের অবদানকে অগ্রগামী গণ্য হতে হলে আরও জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরও গতিশীল, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ।
মোট কর রাজস্বে আমদানি শুল্কের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৪২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২৭%, ০৫%, ০৯%, ২২% ও ১১% অর্থাৎ বড় এলোমেলো এবং অপরিকল্পিত প্রয়াস পরিস্থিতি নির্দেশ করে। ডব্লিউটিওর অনুশাসন মেনে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আসছে তাতে ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক হ্রাস পেতে থাকবে এমন একটা ধারণা বা যুক্তি বিদ্যমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে উচ্চ শুল্কায়নযোগ্য সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে শুল্ক আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির কার্যকরণ সম্পর্কটিও পরীক্ষা পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। মূল্য ওঠানামার সঙ্গে ট্যারিফ স্ট্রাকচারের সমন্ব^য় সাধন, ভ্যালুয়েশনসহ শুল্কায়নে অধিকতর একাগ্রতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও প্রকৃষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর আয়ের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৩৩ শতাংশ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়কর আয়ের সামঞ্জস্যহীন পরিস্থিতি নির্দেশ করে। মূসক আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মিশ্র হারও যথাক্রমে ২৩%, ১৩%, ২৫%, ২৯% ও ২৩% যা মূসক আয়ের টেকসই ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করে না। এ সময়ের (২০০৬-১২) গড় প্রবৃদ্ধি আমদানি (২২%), জিডিপি (৫-৭%) ও মূল্যস্ফীতির (৭-৯%) হিসাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলে স্থানীয় পর্যায়ে পরোক্ষ কর থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়। মোট কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২০০৭-০৮-এর ২৫ শতাংশ থেকে ২০১১-১২তে ৩০-এ উন্নীত হয়েছে যা পূর্ববর্তী সময়গুলোর তুলনায় বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি, এ ধারা আরও বেগবান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে আয়করের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২৭%, ১১%, ১৮%, ২৮% এবং ১৯% অর্থাৎ সুস্থিরভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে পারেনি। আয়কর দাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, তা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। লোকবলের সমাহার ঘটিয়ে সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে পারলে মোট রাজস্বে আয়কর খাতের হিস্যা বাড়ানো সহজতর হবে। কর জিডিপি রেশিও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রয়াস। দেখা যাচ্ছে বিগত কয়েকটি বছরের পূর্বপর্যন্ত আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রাও ছিল অত্যন্ত ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্রমশ কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০:৩০ থেকে ৫৮:৪২-এ পৌঁছেছে। দেশে কর্পোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে কোম্পানি ব্যতীত করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসন, আর্টিফিশিয়াল জুরিডিক্যাল পারসনস রয়েছেন, তাদের করনেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরও জোরদারকরণের অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যারা আয়কর নথি খুলেছেন তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা-প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা করদাতাবান্ধব বা সহজীকরণ করা যাবে তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করনেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে একথা অনস্বীকার্য যে, সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

No comments

Powered by Blogger.