চুল নড়বে নাকি ঢেঁকি নামবে? by মাকসুদুল আলম

জাপানি ভাষায় প্রবাদ আছে- ‘মুখের ভাষাই সর্বনাশের মূল’। মানুষের মুখের ভাষা মধুর হলে তা শত্রুকেও বন্ধু করে। আর তিক্ত হলে বন্ধুকেও করে শত্রু। দৈনন্দিন সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে পেশাগত জীবনেও মানুষকে ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়।
প্রেক্ষাপট বুঝে কথা বলতে হয়। জনভেদে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে হয়। যা মুখে এলো জনসমক্ষে তাই বলে দিলে বেশির ভাগ সময় তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। মানুষ তখন নিজেকে বাচাল মনে করে। দেশ পরিচালনাকারী রাজনীতিকদের বেলায় ভেবেচিন্তে কথা বলাটা আরও বেশি জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে দূতালিক ভাষায় কথা বলতে হয় তাদের। নিজ দল বা বিশেষ কোন মতের স্বার্থে কখনও কখনও কৌশলী হতে হয়। কেননা, জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত। তাই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের জন্ম না দেয়াই রাজনীতিকদের জন্য শ্রেয়। যদিও আমাদের রাজনীতিকরা উল্টোটাই করতে পছন্দ করেন। কথার মারপ্যাঁচে একে অপরকে ঘায়েল করতে আনন্দ পান তারা। তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুনলে মনে হয় যেন ছোট বাচ্চাদের কানামাছি খেলা চলছে। চলতি বছর প্রকাশ্য সমাবেশে সাপ-ওঝা নিয়ে অনাকাঙিক্ষত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন আমাদের দুই শীর্ষ রাজনীতিক। একজন বলেছেন, উনি কালনাগিনী। সাপের ঝাঁপি (জামায়াত) মাথায় নিয়ে খেলছেন। আরেকজন তার জবাব দিয়েছেন। সাপকে বিশ্বাস করা গেলেও, ওদেরকে (আওয়ামী লীগকে) নয়। দিন দুয়েক আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গণভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে তার অবস্থান জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। তার সরকারের আমলে সংশোধিত সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণও নড়বেন না তিনি। বিরোধী দলের দাবি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদ কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়েছেন দেশবাসী। উদ্বেগ প্রকাশ করে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরাও। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-ও তড়িঘড়ি করে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। না নড়লে খেলা হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে কোন পাতানো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিক্রিয়া এসেছে পরদিন। জবাব দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা। সময় গেলে সাধন হবে না। আফসোস করতে হবে। তিনি বলেছেন, এত আস্ফালন ভাল না। জনগণের আন্দোলনের বাতাসে চুল থাকবে না। উড়ে চলে যাবে। নিজেদের অস্তিত্বেও টান পড়তে পারে। তাতে দিশাহারা হয়ে যাবেন। ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের মতে, ‘স্বৈরাচারী সরকার চুল পরিমাণ নড়বে, নাকি ঢেঁকি বরাবর নামবে তা সময়ই বলে দেবে।’ প্রবীণ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টকশো ব্যক্তিত্ব এ বি এম মূসার মতে, চুল ফেলে দিলেই হয়। তাহলে চুল নিয়ে এত নড়াচড়া কিংবা মাথাব্যথার কারণ থাকবে না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে চুল নড়বে নাকি ঢেঁকি নামবে তা একমাত্র আমাদের রাজনীতিকরাই ভাল জানেন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেয়ে, সংঘাতের পথ বেছে নেয়াই তাদের বেশি পছন্দ। তারা যে গণতন্ত্রের চর্চা করেন সেখানে সংলাপের স্থান নেই। রক্তারক্তিতেই বেশি অভ্যস্ত তারা। সেখানে সব সরকারের আমলেই সোজাপথে ক্ষমতা হস্তান্তরে ক্ষমতাসীন দলের যত আপত্তি। উভয় দলই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চায়। কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতার মসনদে থাকতে চায়। তারা কেউই ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না। ফেসবুকে নিয়মিত কানামাছি খেলছেন সরকারের প্রযুক্তিবিদ তথ্য উপদেষ্টা। ছোটবেলায় ছোট মামার খেলনা নিয়ে খেলতেন। প্রযুক্তি রপ্ত করে এখন ফেসবুক ও টুইটারে খেলা শিখেছেন। প্রায় প্রতিদিন বিগত সরকারের গিবত গেয়ে স্ট্যাটাস দেন। পৈতৃক আদিবাড়ির দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেন, খেলায় তিনিও আছেন। জন্মদিন পালন শেষে নিজ দেশে ফিরে গেলেও, খেলা থেকে বাদ যাননি। জানামতে সরকারি দলের বা সরকারের মন্ত্রিসভার কোন সদস্য না হয়েও দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা। তিনিও সরকারের মন্ত্রিসভার পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত কোন উপদেষ্টা কিনা কে জানে? সমাজসেবা বা অটিজম উপদেষ্টা হলেও হতে পারেন। নিজের মেয়েকে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে পাঠানোর পেছনেও হয়তো চলছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়তো নিজের পরিবারের সদস্য ছাড়া বিশ্বাস করতে পারছেন না অন্য কাউকে। পরিবারতন্ত্রের মোড়কে হয়তো চলছে খেয়ালখুশিমতো সরকার পরিচালনা। সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে হয়তো চলছে সত্যিকারের রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র। সেদিন গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। বর্তমানে বিদ্যুতের কোন ঘাটতি না থাকলেও মানুষ যাতে লোডশেডিংয়ের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে সেজন্য তিনিই নাকি লোডশেডিং বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে পত্রিকার খবরে আমরা জেনেছি, ভাড়াভিত্তিক কুইক রেন্টাল বাবদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার বিগত সাড়ে চার বছরে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। বিনা টেন্ডারে সরকারদলীয় লোকজনকে কাজ দেয়ায় এ ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। কুইক রেন্টালের বিশাল ভর্তুকির মাশুল চাপানো হয়েছে জনগণের ঘাড়ে। তাছাড়া এ সরকারের আমলেই বেশ কয়েক দফায় বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। তারপরও কেন কথায় কথায় সাধারণ জনগণকে বিদ্যুৎ নিয়ে খোঁটা দেয়া হয়, তা বোধগম্য নয়। ভোট না দিলে বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে কেন রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে হুমকি দেয়া হয়, তা ভাবতেও অবাক লাগে। রাষ্ট্রের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আশা করবো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও গণভবনকেও এ লোডশেডিংয়ের আওতায় আনা হবে। বাড়তি খেসারত দিয়েও কেন একতরফাভাবে লোডশেডিংয়ের কষ্ট শুধু সাধারণ জনগণকেই উপলব্ধি করতে হবে? তাহলে আর দেশ পরিচালনার প্রয়োজন কি? আশা করি একবার তা ভেবে দেখবেন।
 
মাকসুদুল আলম টোকিও থেকে

No comments

Powered by Blogger.