ফ্রন্টলাইনে শিবির by সাজেদুল হক ও জাকারিয়া পলাশ

বিপর্যস্ত জামায়াত। আক্রমণের পর আক্রমণে ছিন্নভিন্ন। নির্বাচনী রাজনীতিতে নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপর কি? মঞ্চে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব। আবার ফ্লাশআউট। বিপদের মুখে পলিটিক্যাল ইসলাম।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়াতেই। কেমন হবে ভবিষ্যতের পলিটিক্যাল ইসলাম? জামায়াত আর ইসলামী রাজনীতি নিয়ে আমাদের গবেষণা আর অনুসন্ধানের ধারবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব আজ।

সাজেদুল হক/জাকারিয়া পলাশ: এতে হয়তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাজপথে এখন সবচেয়ে সক্রিয় ছাত্রশিবির। জামায়াতের আন্দোলনের মূল ফোর্সে পরিণত হয়েছে বহুল আলোচিত এ সংগঠনটি। যদিও রাজপথে সহিসংসতার জন্যও শিবির অভিযুক্ত। সংগঠনটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগও পুরনো। তবে শিবিরের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, রাজপথে শিবির এখনও পুরো শক্তি প্রদর্শন করেনি। অক্টোবরের প্রথম সপ্তা’ থেকে  রাজপথে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে শিবির কর্মীরা।
১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে প্রথম আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ছাত্রশিবির। মীর কাসেম আলীকে সভাপতি আর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল এর প্রথম কমিটি। এখন শিবিরের প্রথম কমিটির দুই শীর্ষ নেতাই কারাবন্দি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এরই মধ্যে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। তিনি এখন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি পদেও বহাল রয়েছেন। মূলত দীর্ঘদিন থেকেই জামায়াতের আন্তর্জাতিক সংযোগ রক্ষা করছিলেন তিনি। জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী অবশ্য কখনও প্রকাশ্য রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না। জামায়াতের বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগের তিনি নেতৃত্বে ছিলেন।
প্রতিষ্ঠার পর শিবির প্রথম চট্টগ্রাম এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এজন্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেচে নেয় সংগঠনটি। এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় সংগঠনটি। তবে এক্ষেত্রে শিবিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিপক্ষের রগ কেটে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও শিবির বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলেছেন, প্রতিপক্ষ এবং মিডিয়া শিবিরকে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েই অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবির তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে একের পর এক সংঘর্ষে জড়ায় শিবির কর্মীরা। এতে সবপক্ষেরই ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কখনও তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এখানে শিবিরের বিরুদ্ধে অন্যসব ছাত্র সংগঠনই ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রেখেছে। যদিও আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী সক্রিয়। ভিন্ন সংগঠনে মিশে যাওয়াও এখানে শিবিরের অন্যতম পলিসি। কৌশলের অংশ হিসেবেই শিবিরের অনেক কর্মী এখানে ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বেও স্থান করে নেন তারা।
বর্তমান সরকারের আমলে শুরুর দিকে কিছুই নিরবই ছিল শিবির। জামায়াতের শীর্ষ সব নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে গত নভেম্বর থেকে রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করে সংগঠনটি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ দেশের প্রধান প্রধান মহানগরীর রাজপথে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করেন শিবিরের প্রশিক্ষিত নেতা-কর্মীরা। কয়েকটি স্থানে পুলিশের ওপর হামলাও চালান তারা। একপর্যায়ে শিবির নেতা-কর্মীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে। এরপর রাজপথে নামলেই গুলির মুখে পড়তে হয় শিবির নেতা-কর্মীদের। যে গুলিতে তাদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। ককটেল বিস্ফোরণ আর সহিংসতায় জবাব দেয় শিবির কর্মীরা। যে সহিংসতায় কয়েকজন পুলিশও প্রাণ হারান। এ মূহর্তে শিবিরের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ, তাদের বাহিনীর কাছেও এটা পরিষ্কার জামায়াতের মূল ফোর্স এখন শিবির। শিবিরকে অকার্যকর করা গেলে সহিংসতা আর আন্দোলন অনেকটাই দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে। শিবির সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেনসহ সংগঠনটির অনেক শীর্ষ নেতারই এখন কারাগারে। শিবির সভাপতির উপর চালানো নির্যাতন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সংগঠনটির চার হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মী এখন গ্রেপ্তার রয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৮ জনেরও বেশি।
তবে ছাত্রশিবির স্বতন্ত্র সংগঠন বলে দাবি করলেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি এবং জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ছাত্রশিবির বাস্তবভাবে জামায়াতের নিকট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সংগঠন। কখনই ছাত্রশিবির জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ছিল না। আদর্শিকভাবে তারা একই উদ্দেশের অনুসারী। বর্তমানে যেসব কার্যক্রম চলছে তা শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধে নয়। সকল ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধেই এ ভূমিকা নিচ্ছে সরকার। তাই ইসলামী সংগঠন হিসেবে শিবির জামায়াতের কর্মসূচিতে সমর্থন বা অংশগ্রহণ করছে। সুতরাং, শিবিরকে দিয়ে আলাদা সংগঠন হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
মঙ্গলবার শিবিরের সেক্রেটারি আবদুল জব্বার বলেন, সরকারের ধারাবাহিক নির্যাতন সয়েও শিবির নেতৃবৃন্দ যেভাবে সারা দেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা এ সংগঠনের শক্তিমত্তাকেই প্রমাণিত করে। সরকার শত চেষ্টা করেও জামায়াত-শিবিরকে দমাতে পারেনি, পারবেও না। দেশের প্রতিটি জেলায় শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহীদ হয়ে, বুকের রক্ত ঢেলে ছাত্রশিবিরকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.