ফুলন দেবী যেভাবে দস্যুরানী by কাজী সুমন

বনের রানী ফুলন দেবী। ঘন জঙ্গল আর রাতের অন্ধকার তার জীবনের বড় একটা অংশ কেড়ে নিয়েছিল। বঞ্চনা আর কষ্ট সইতে না পেরে তিনি অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মানুষের আড়ালে যাওয়ার আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হন। সবকিছু শেষ হওয়ার পর ফুলন তার খোলস বদলে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ভয়ংকর দস্যুরানী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সবার কাছে  তবে কুখ্যাত খুনির তালিকায় তার নামটা না এলেও পারতো। কারণ, প্রথম জীবনের বঞ্চনা এবং পরের জীবনের বিদ্রোহ তার প্রতি মানুষের একটা সহমর্মিতা তৈরি করেছে। এরপরও কেবল প্রতিশোধের নেশায় একের পর এক মানুষ হত্যা দস্যুরানী ফুলন দেবীকে ইতিহাসের অন্যতম খুনি হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। তার জন্ম ১৯৬৩ সালে ভারতের এক নিচু পরিবারে। দারিদ্র্য এবং সামাজিক কারণে জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রামের মুখোমুখি হন ফুলন। মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবার বয়সী এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ফুলনের গ্রাম এবং আশপাশের একাধিক গ্রামে ঠাকুর বংশের জমিদারি ছিল। আর জমিদারের লোকেরা প্রায়ই গ্রামের দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছ থেকে ফসল কেড়ে নিয়ে নিতো এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালাতো। ফুলন এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে দখলকারীদের নেতা মায়াদীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঠাকুররা তাকে ধরে নিয়ে যায় বেমাই নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে। এরপর তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ঠাকুর ও তার লোকেরা ফুলনকে ধর্ষণ করে। প্রতি রাতেই ফুলন জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত চলতো এ পাশবিকতা। ১৬ দিনের মাথায় এক রাতে নির্যাতন শেষে ফুলনকে মৃত মনে করে ফেলে রাখে তারা। আর প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী ফুলন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তখন ফুলনের বয়স ছিল মাত্র সতের। পালিয়েও রক্ষা পেলেন না ফুলন। আরেকবার ধরা পড়লেন এক দস্যুদলের হাতে। দস্যুদের নেতা বাবুর নজর পড়ে ফুলনের ওপর। সে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল ফুলনের ওপর। কিন্তু আরেক দস্যু এতে বাধা হয়ে দাঁড়াল। বাবুকে খুন করে ফুলনকে রক্ষা করে সে। এরপর ফুলনের সঙ্গে বিক্রমের বিয়ে হয় এবং শুরু হয় ফুলনের নতুন জীবন। রাইফেল চালানো শিখে পুরোদস্তুর দস্যু হয়ে ওঠেন তিনি। ফুলন তার আলাদা বাহিনী নিয়ে প্রথম হামলা চালায় তার সাবেক স্বামীর গ্রামে। নিজ হাতে ছুরিকাঘাতে তার স্বামীকে খুন করে রাস্তায় ফেলে রাখে। ফুলন তার সংগঠিত দস্যুদল নিয়ে ক্রমাগত ধনী গ্রাম এবং জমিদার বাড়িগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যায় ফুলন। সেখানে ফুলন খুঁজে পান এমন দু’জন মানুষকে, যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলন দেবী আদেশ করেন বাকি ধর্ষণকারীদেরও ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় ঠাকুর বংশের ২২ জনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বেমাইয়ের এ গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সরকার ফুলনকে ধরার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। আবার ফুলনের পক্ষেও আন্দোলন হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার সন্ধি প্রস্তাব করলে ফুলন অনেক শর্ত দেন। সরকার সেই শর্ত মেনে নিলে ১০,০০০ মানুষ আর ৩০০ পুলিশের সামনে ফুলন দেবী অস্ত্র জমা দেন গান্ধী আর দুর্গার ছবির সামনে। ১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ এবং ‘৯৯-তে পরপর দুইবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ২৫শে জুলাই ঠাকুর বংশের তিন ছেলের এলোপাতাড়ি গুলিতে ফুলন দেবী নিহত হন।

No comments

Powered by Blogger.