গোলাম আযমের বিচার ত্রুটিপূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। প্রসিকিউশনের প্রতি বিচার বিভাগ অত্যন্ত পক্ষপাতিত্ব করেছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করভাবে অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে গতকাল কড়া সমালোচনা করে এসব কথা বলেছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ‘বাংলাদেশ: আযম কনভিকশন বেজড অন ফ্লড প্রসিডিংস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে এ সংগঠনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি। ২০১০ সালের মার্চে ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি দেয়া, দুষ্কর্মে সহযোগিতা, হত্যা এবং নির্যাতনের মোট ৬টি অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। এ আদালত আইসিটি নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব লোক যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছিল তাদের বিচারের জন্য এ আদালত গঠন করা হয়। এ বছরের ১৫ই জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয় তাতে তাকে সব কটি অভিযোগে অভিযুক্ত দেখানো হয় এবং শাস্তি হিসেবে তাকে ৯০ বছরের জেল দেয়া হয়। তিনি অনেক বয়সী। তার বয়সের কথা বিবেচনা করে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন আপিল করেছে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে। এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, ১৯৭১ সালে যারা নৃশংসতা ঘটিয়েছিল তাদের বিচার, নির্যাতিত ও জীবিতদের অর্থপূর্ণ বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে নিশ্চিত করার প্রতি দীর্ঘদিন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আমরা সতর্কতা উচ্চারণ করেছিলাম, আইন ও বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ নয়। কিন্তু সরকার আমাদের সে সতর্কতা প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকার চেয়েছিল তাকে অভিযুক্ত করতে। তারা তা পেয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করে এমন বিচার আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
গোলাম আযমের বিচার নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার মধ্যে রয়েছে-
১.    যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত করিয়েছেন বিচারকরা।
২.    প্রসিকিউটর ও বিচারকদের মধ্যে গোপন যোগাযোগ ও পক্ষপাতিত্ব ছিল।
৩.    বিবাদীর সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা।
৪.    আদালতের প্যানেলে পরিবর্তন এবং
৫.    সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত করার ক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মধ্যে একটি হলো- বিচারকরা বলেছেন, প্রসিকিউশন যে মামলার প্রতিনিধিত্ব করছেন তাতে যেসব ঘাটতি রয়েছে তা সম্পূর্ণ করতে তারা তদন্ত করিয়েছেন। কোন মামলায় বিচারকদের সামনে যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয় তা যাচাই করার একমাত্র ক্ষমতা বাংলাদেশে বিচারকদেরই আছে। এসব তদন্ত সম্পর্কে বিবাদীপক্ষ কাউন্সেল অবহিত ছিলেন না। অথবা বিচারকরা যেসব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তা চ্যালেঞ্জও করতে পারেননি বিবাদীপক্ষের কাউন্সেল। ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের ১৪ ধারার মারাত্মক বরখেলাপ এ ঘটনা। এ অধিকার বিষয়ক রুলে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। তদন্ত নিয়ে আদালতের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। স্কাইপ ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে বিচার বিভাগ, প্রসিকিউশন অথবা নির্বাহী শাখা বিদেশে অবস্থানরত আইনজীবীর সঙ্গে যোগসাজশের যে তথ্য দ্য ইকোনমিস্ট প্রকাশ করেছে তাতে বিচার বিভাগের পক্ষপাতিত্বের বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে আইসিটি কোন উত্তর দেয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরেই স্কাইপ কথোপকথনের কিছু অংশ সম্পর্কে মন্তব্য করে। এতে কিভাবে বিচার প্রক্রিয়া চলবে, কোন সাক্ষীকে ডাকা হবে, কিভাবে তাদের প্রশ্ন করতে হবে ইত্যাদি বিষয় ছিল ওই কথোপকথনে। এতে আরও বলা হয়, বিচারকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে আরও বিষয়। গোলাম আযমের মামলাসহ অন্যান্য মামলায় বিবাদীপক্ষের সাক্ষীদের ভীতি প্রদর্শন ও বিবাদীদের চেম্বারে তল্লাশি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। বিবাদী পক্ষের সাক্ষীরা নিরাপত্তা নিয়ে যেসব ঝুঁকির কথা বলেছেন তা তদন্ত বা তার কোন সমাধানের কথা বলেননি ট্রায়াল চেম্বার। ব্রাড এডামস বলেন, গোলাম আযমের বিচারে সমস্যা অনেক। এতে প্রকাশ হয় যে, প্রসিকিউশনের প্রতি মারাত্মক পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে মারাত্মকভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। যারা অপরাধের শিকার ও তাদের পরিবার অপরাধের সঠিক বিচার অবশ্যই প্রাপ্য। সেই বিচার হতে পারে শুধু অবাধ ও স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে।

No comments

Powered by Blogger.