‘নিজেরা চুলোচুলি করলেও আমার বেলায় সবাই হাতে হাত মেলায়’

বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার দেশে ফেরা প্রসঙ্গে বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলই এক্ষেত্রে বাধা। দলগুলো নিজেরা চুলোচুলি করলেও আমার ঢোকার দরজা তালা দিয়ে রাখে। সবাই হাতে হাত মেলায়।
সমপ্রতি রাজেন্দ্র যাদব সম্পাদিত হিন্দি সাহিত্য পত্রিকা ‘হংস’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। দেশে ফেরার আশা দেখতে পাচ্ছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার  বেলায় সব রাজনৈতিক দলই একই ভূমিকা পালন করে। আমি দেশে গেলে মৌলবাদীরা যদি সরকারকে দোষ দেয়, দু’টো ভোট যদি আবার নষ্ট হয়ে যায়, সে কারণে কেউ ঝুঁকি  নেয় না। ন্যায়ের পক্ষে বা সত্যের পক্ষে রাজনীতিবিদরা খুব একটা দাঁড়ায় না। আমি সত্যি বলতে কি আশা ছেড়েই দিয়েছি। কলকাতায় ফেরা প্রসঙ্গে বলেন, অনেক চেষ্টা করেছি কলকাতায় ফেরার। নতুন সরকারের কাছেও আবেদন করেছি। কিন্তু ওরা রাজি নন। সিপিএমের সঙ্গে সমস্ত বিষয়ে তৃণমূল দ্বিমত পোষণ করলেও আমার বিষয়ে একমত। এখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আমি  কোন পার্থক্য দেখি না। এশিয়ার বাইরে  আপনার এত সমর্থন কিন্তু এখন পর্যন্ত এশিয়ায় একটিও সামাজিক সামগ্রিক আওয়াজ উঠলো না কেন আপনার পক্ষে? এমন প্রশ্নের জবাবে তসলিমা বলেন, এশিয়া এখনও প্রস্তুত নয় আমি যে কথাগুলো বলছি,  সেগুলো মেনে নিতে। এশিয়া এখনও ঘোর পুরুষতান্ত্রিক, এখনও ধর্মান্ধ। তবে এশিয়ার সাধারণ পাঠকদের প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি বলে তিনি দাবি করেন। তবে যারা ভালবাসে, সমর্থন করে, সম্ভবত তারা সংগঠিত নয়। আপনি যা কিছু করেছেন, তা ছাড়াও সামপ্রতিককালে মালালা, আমিনা ওদুদ, বীণা শাহ এবং আরও অনেক আওয়াজ উঠেছে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। এখন থেকে দশ/কুড়ি বছর পরের কি পরিবর্তন দেখতে পান, মুসলমান মহিলাদের জীবনে কি প্রগতি  দেখতে পান? এমন প্রশ্নে তসলিমা নাসরিন বলেন, দশ বা কুড়ি বছরে খুব যে পরিবর্তন  দেখতে পাবো, তা মনে হয় না। মুসলিম  দেশগুলোতে এখনও ইসলামী মৌলবাদী  গোষ্ঠী প্রচণ্ড শক্তিশালী। ব্যক্তিগতভাবে কেউ  কেউ প্রতিবাদ করছে বটে, তবে এ প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ না রাষ্ট্রশক্তি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, নারী-সংগঠন একযোগে মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যবস্থা  না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার প্রগতির কিছু ঘটবে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধর্ম আর রাজনীতিকে  মেশালে ধর্মও নষ্ট হয়, রাজনীতিও নষ্ট হয়। এ দু’টোর আলাদা থাকাটা খুবই জরুরি। যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে আলস্য  বোধ করে, অথবা বিজ্ঞানকে জানতে গিয়ে  দেখেছে রীতিমতো কঠিন ব্যাপার এটি, তারা ধর্মে আশ্রয় নেয়, ধর্মে আরাম বোধ করে,  যেহেতু ধর্মই সবকিছুর সহজ এবং চমৎকার সমাধান দেয়, ধর্ম সম্পর্কে জানতে কোন  বুদ্ধি খাটাতে হয় না, গভীরভাবে ভাবতে হয় না, কোন প্রশ্ন করারও দরকার হয় না। ঠিকঠাক রাজনীতিটা হলে মানুষ সুখে-স্বস্তিতে থাকে, অভাব-অনটন দূর হয়, সবার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়, কাজকর্মের সুযোগ ভাল হয়, দুর্নীতি-বদনীতির প্রকোপটা কমে যায়। রাজনীতির মধ্যে ধর্মের ছিটেফোঁটা ঢুকলেই সর্বনাশ। পশ্চিমা মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি বলেন, ইউরোপ যে এত প্রাণপাত করছে মানবাধিকারের জন্য, ইউরোপ, বিশেষ করে
পশ্চিম ইউরোপ এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে না কেন! ভারতের আশ্রয়ের কথা উঠছে কেন! ভারত দিতেই পারে তাকে আশ্রয়। কিন্তু ভারত হয়তো ভাবছে এসময় আমেরিকার সঙ্গে শত্রুতা করা উচিত হবে না। ভারতের এক শ’ রকম সমস্যা। এক ডজন মুসলিম মৌলবাদী রাস্তায়  নেমে খানিকটা চেঁচালেই ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশ্রিত লেখককে রাজ্য থেকে বা  দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার, সেখানে কি করে ভাববো স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে আমেরিকার মতো ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে ভারত দাঁড়াবে। আপনি কি ভবিষ্যতে গৃহস্থ জীবনে নিজেকে  সেটেল করার কথা ভাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার যে জীবন, সে জীবন কি অগৃহস্থ জীবন? আমি কি কোন ঘরে ঘুমোই না, চাল-ডাল কিনি না, রাঁধি না, খাই না? ঘুমাই, রাঁধি, খাই। আমার ঘরে কি অতিথিরা, আত্মীয়রা বেড়াতে আসে না? আসে। স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করাই কি গৃহস্থ জীবন? ওইসব ক্ষুদ্র সংজ্ঞা থেকে আমি অনেককাল ধরে মুক্ত।

সূত্র: তসলিমা নাসরিনের ব্লগ থেকে

No comments

Powered by Blogger.