দি ইকোনমিস্টের আইকম্যান বন্দনা ও কিছু কথা by এরশাদুল আলম প্রিন্স

অবশেষে অ্যাডলফ আইকম্যানের বিচার প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দি ইকোনমিস্ট। গত ২৩ মার্চ পত্রিকাটি ‘Justice in Bangladesh-Another Kind of Crime: Bangladesh’s war-crimes tribunal is sullying its judicial and political systems’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পত্রিকাটি প্রথমেই ইনিয়ে-বিনিয়ে আইকম্যানের বিচার প্রক্রিয়া খুব সচেতনভাবে করা হয় বলে দাবি করে। বলা হয়, বিচার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ও আইনের যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কিন্তু পত্রিকাটি সে বিচার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত কোনো বর্ণনা দেয়নি। দেয়নি সচেতনভাবেই। কারণ সে বর্ণনা দিলে আইকম্যান ট্রায়ালের ত্রুটি সমূহও বর্ণনা করতে হবে।
তবে যেটুকু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, আইকম্যানকে আর্জেন্টিনায় অপহরণ (আইনের ভাষায় অপবাহন)করে নিয়ে তার বিচার করা হয়। আইকম্যানকে কুড়ি বছর আগের অপরাধের জন্য বিচার করা হয়।

স্বীকার করছি, আমাদের ব্যর্থতা হচ্ছে আমরা ৪০ বছর আগে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করা হয়েছে সে অপরাধের মূল অপরাধীদেরকে পাকিস্তান থেকে জোর করে ধরে (ইকোনোমিস্টের ভাষায় ‘অপহরণ’)নিয়ে এসে তাদের বিচার করতে পারিনি। আমরা হাতের কাছে যাদের পেয়েছি তাদেরই বিচার করছি। কিন্তু চোর ধরতে পারিনি বলে, চোরের সাহায্যকারীদের বিচার করা যাবে না এমন আইন কোথাও নেই।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে তাতে নিজ দেশের অপরাধীদের বিচার করাই দায়। পাক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বললেতো ওলট-পালট করে ফেলতো।
আর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার ৪০ বছর নয়, ১৪০ বছর পরে হলেও তার বিচার করতে হবে। এটাই মানবতার দাবি। সে বিচার না করাটা আরেকটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। জাতি এ অপরাধ আর করতে চায় না। আমরা আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। নতুন করে আর ভুল করতে চাই না।

আইকম্যান নাজি বাহিনীর ওয়াননেস কনফারেন্সের সেক্রেটারি ছিলেন। এ বাহিনীটি যুদ্ধাপরাধ ও ধ্বংসযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা ও পরিচালনাকারী ছিল। যদি আইকম্যানের বিচার করা জায়েজ হয়, তবে ৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার করা কেন নাজায়েজ হবে তা বোধগম্য নয়। অথনীতিবিদের (The Economist) কাছ থেকে বিচারের ছবক নেওয়া মন্দ নয়।

পত্রিকাটি নিজেই বলছে, আইকম্যানের বিচারের বাদী(রাষ্টপক্ষের)পক্ষের আইনজীবী ছিলেন ইসরাইলের অ্যাটর্নি জেনারেল। আর তার নিজের আইনজীবী ছিলেন জার্মান আইনজীবী। ইসরাইল আইকম্যানকে ধরে নিয়ে এসে ‍তার বিরুদ্ধে ইসরাইলি আইনজীবী দাঁড় করালো- এতে বিচার প্রক্রিয়ার কী মাহাত্ম প্রকাশ পেল তা বোধগম্য নয়।

এ দ্বারা পত্রিকাটি কী বোঝাতে চেয়েছে তাও স্পস্ট নয়। তবে কি সাঈদীদের জন্য পাকিস্তানী আইনজীবী নিয়োগ করা উচিত ছিল?

এও বলা হলো, আইকম্যানের বিচার প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। কোনো বিচার প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেই কি তা স্বচ্ছ হয়ে যায়। তবে তো আমরা সাম্প্রতিককালে সাদ্দামসহ আরো অনেকের বিচার করার কিছু দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখেছি। কিন্তু তাতে কি সে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়ে গেলো? বরং সাম্রাজ্যবাদীদের করা প্রত্যেকটি বিচার প্রক্রিয়া ইতিহাসের পাতায় প্রশ্নবিদ্ধ।

পত্রিকাটি দাবি করেছে, যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আইনসম্মতভাবে বিচার হয়েছিল আইকম্যানের। আমাদের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও সম্পূর্ণ আইনসম্মত ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই করা হচ্ছে। আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খু বিচার বিশ্লেষণ করেই ৭৩ সালের আইনটি প্রণয়ন করা হয় ও সেই আইনানুযায়ী বিচার হচ্ছে। বরং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের বিশ্লেষকরা এ আইনটিকে অনেক ক্ষেতেই প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের চেয়েও আধুনিক ও আসামিদের বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছে বলে মত দিয়েছেন।
   
পত্রিকাটি ইসরাইলি বিচার প্রক্রিয়াকে মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করে দাবি করছে যে আমাদের বিচার প্রক্রিয়া নাকি সেই মানের হয়নি। কিন্তু কীভাবে তার কোনো বর্ণনা নেই। আইকম্যানের ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে আর সাঈদীর ক্ষেত্রে কী করা হলো না তার কোনো বর্ণনা নেই প্রতিবেদনটিতে।

পত্রিকাটি বলছে, সরকার আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের কাছে প্রশ্ন, পৃথিবীর কোন আদালত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেনি? সেই হস্তক্ষেপ কতটুকু নেতিবাচক সেটিই প্রশ্ন। সরকার আদালতের বিচার কাজ ত্বরান্বিত করেছ- এটাতো হস্তক্ষেপ হতে পারে না।

তারপরও একজন বিচারককে নিয়ে সমালোচনা হওয়ার পরে সাথে সাথেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। স্বচ্ছতার এটি একটি বিরল নজির।

উল্টো ইকোনমিস্টের কাছে আমরা প্রশ্ন করতে চাই-আজ অবধি পৃথিবীর কোনো যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচারককে নিয়ে বিতর্ক হলেও কেউ কি পদত্যাগ করেছে? না, আজ পর্যন্ত কোনো বিচারকই সমালোচনার জন্য সরে দাঁড়ান নি। আমাদের বিচারক সরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তারপরও সমালোচকদের মনোপীড়া!

বলা হয়েছ, আমাদের আদালত নিয়ে নাকি কোনো সমালোচনা করা যায় না।কী নিদারুণ মিথ্যাচার!

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আদালত নিয়ে দেশের ভেতর ও বাইরে যে সমালোচনা হয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনো আদালত নিয়ে হয়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে সমালোচনা ছিল ভিত্তিহীন। বিচার বানচাল করার নামান্তর। তারপরও সমালোচনাকে পরামর্শ হিসেবেই বিবেচনা করেছে সরকার ও আদালত। পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েও এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

একটি রায় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে পত্রিকাটি। বলছে, বিচারক সব সাক্ষীদের জবানবন্দী না নিয়েই রায় প্রদান করেছে। আদালত যদি মনে করে অপরাধ প্রমাণ করার জন্য আর কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন নাই তাহলে তিনি আর জবানবন্দী গ্রহণ নাও করতে পারেন। এটি আদালতের এখতিয়ার। এর সাথে আদালতের স্বচ্ছতার কোনো সম্পর্ক নেই।

এক (আসামি পক্ষের)আইনজীবী মামলা পরিচালনার জন্য যথাযথ সময় পান নি এমন অভিযোগও করেছে পত্রিকাটি। এটি যেকোনো আসামিরই একটি সাধারণ অজুহাত যা কারো অজানা নয়। আজ পর্যন্ত কোনো আসামি পক্ষের আইনজীবী পরাজিত হলে ন্যায়বিচার পেয়েছেন এমন দাবি করেন নি।বরং ন্যায় বিচার পান নি এমন দাবিই করে থাকেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা।

ইকোনমিস্টের দাবি, এ বিচার নাকি বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক।কিন্তু কোন আইনের সাথে কীভাবে সাংঘর্ষিক তার কোনো ফিরিস্তি নেই। দেওয়া সম্ভবও না।

ইকোনোমিস্টের এ প্রতিবেদনটি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত তা প্রতিবেদনটি পড়লেই বোঝা যায়। এক পর্যায়ে পত্রিকাটি বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই এ বিচার প্রক্রিয়ার সূচনা। যদি তা হয়েও থাকে তবে তাতে সমস্যা কোথায়। বিচার করলে যদি কেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সে জন্য কি বিচার বন্ধ করতে হবে? সমাজের কাজ  অপরাধীদের বিচার করা ও তাদেরকে চিহ্নিত করা। রাষ্ট্র ও সমাজ আদালতের মাধ্যমে এ কাজটি করে থাকে।

অপরাধী হিসেবে নাজি নেতাদেরও তো বিচার করার পর তাদের দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নাজি-আইকম্যান সব অপরাধী, আর সাধু হলো জামায়াত?

ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদনটি বলেছে, মৃর্ত্যুদণ্ডকে ভূতাপেক্ষ (Retrospective Effect) কার্যকর করা হয়েছে। বিষয়টি মোটেই তা নয়। বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা হয়েছে কেবল। যেখানে সরকারকেও আপিল করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এবং এ সংশোধনীটি  করাও হয়েছে আসামি আপিল করার আগেই। ভূতাপেক্ষ কার্যকরের অর্থও পত্রিকাটি বুঝতে ভুল করছে।

পত্রিকাটি শেষের দিকে বলছে, বাংলাদেশিরা এক সময় বুঝতে পারবে যে তারা ভুল করেছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।আরো বলছে, বাংলাদেশ পুকুরের জলে বিষ মেশাচ্ছে যেখান থেকে তাদের একদিন পানি পান করতে হবে।

আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটির কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে এ ধরনের কথা বলা নিশ্চিতভাবে একটি দেশ ও জাতির বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জাতীয় প্রতিবেদন দেশের মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচালেরই অংশবিশেষ। দেশীয় মদদদাতাদের খপ্পড়ে পড়ে একটি আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমও যে বিভ্রান্ত হতে পারে The Economist-সেটাই প্রমাণ করলো।

যাই হোক, তাদের এই আশঙ্কা বা হুমকি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিবাচক সমালোচনা সব সময়ই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সমালোচনার নামে বিচার প্রক্রিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া প্রত্যাখ্যানযোগ্য।

পত্রিকাটি প্রথম থেকেই যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। পত্রিকাটির বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় তাদের উদ্দেশ্য কী।

শুধু ইকোনমিস্ট নয়, পৃথিবীর আরো কয়েকটি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠন যুদ্ধাপরাধ আদালতের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সে সব প্রতিবেদন একই সূত্রে গাথা। তাদের উদ্দেশ্যও অভিন্ন।

দেশের একটি মহল বিচার ব্যাহত করার জন্য যে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এটি তারই ধারাবাহিকতা। কিন্তু ওইসব গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার মানবতার দাবি।

No comments

Powered by Blogger.