বিচার বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষ ছিলেন তৎপর by অশোকেশ রায় ও জেসমিন পাঁপড়ি

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম থেকেই ট্রাইব্যুনালের বিচারিক পদ্ধতিমালার নানা অপব্যবহার করার অভিযোগ উঠছে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় ট্রাইব্যুনাল অনেককে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে অনেক আইনজীবীকে শো’কজ করার পাশাপাশি একজন আইনজীবীকে এজলাসকক্ষে নিষিদ্ধ করা (পরে শর্তসাপেক্ষে বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়) এবং কয়েকজনকে জরিমানা বা সতর্ক করাসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 
২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় প্রথম ট্রাইব্যুনাল। বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, বিচার ভণ্ডুলে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ওঠা অপতৎপরতার বিভিন্ন দিকগুলো হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণের চেষ্টা, মিডিয়ার কাছে বিচারের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র দিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিচারটিকে ‘মিডিয়ার বিচারে’ পরিণত করার অপচেষ্টা, আদালত কক্ষের পাশাপাশি মিডিয়াকে বিচার ও লবিঙের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের হয়রানি এবং হুমকি প্রদান, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বাইরে গিয়েও আলাদাভাবে যোগাযোগ করা ও ভাষ্য আদায় করা, সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য যে গোপন ‘সেফ হাউস’ রয়েছে, সেখানকার দলিলপত্র ‘যার ভেতর সাক্ষীদের পরিচয় এবং অন্যান্য গতিবিধির বিস্তারিত লিপিবদ্ধ ছিল (যা কঠোরভাবে গোপনীয়)সেগুলো ‌‌‌‌‌‘জাল’ করা, অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান ও বিচারপতিদের টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আবেদন ও সম্মানহানির চেষ্টা এবং বিচারাধীন বিষয়ে চেয়ারম্যানকে সরাসরি চিঠি লিখে (পদ্ধতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক আবেদন নয়) তাকে বিচারকের আসন থেকে নেমে যেতে বলা ইত্যাদি।

এর বাইরেও আইন ও বিধি-বিধানবিরোধী নানা আবেদন করা, খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেও একই ধরনের আবেদন বারবার করা এবং খোঁড়া অজুহাতে আদালতে নিজেরা বা সাক্ষীদের অনুপস্থিত রেখে বিচারিক প্রক্রিয়াকে দীর্ঘসূত্রতায় ফেলা বা বিলম্বিত করার অপচেষ্টার অভিযোগ উঠছে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।

ট্রাইব্যুনালের আদেশের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনও করা হচ্ছে বার বারই। এমনকি বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে অসদাচারণ করা, আদালত অবমাননাসহ নানা অভিযোগে বাধ্য হয়েই ট্রাইব্যুনাল ব্যবস্থা নিয়েছেন আসামি ও তাদের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।

রাষ্ট্রপক্ষ এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে নানা অভিযোগও তোলেন আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। তারা দাবি করেন, ‘‘আসামিপক্ষ এসব করে বিচারিক প্রক্রিয়াকে বানচাল, বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ অথবা দীর্ঘসূত্রতায় ফেলতে চেয়েছেন, যা যুদ্ধাপরাধের বিচারকেই ভণ্ডুল করার অপচেষ্টায় পরিচালিত হয়েছে।’’
তবে বিচারকদের বিচক্ষণতায় এসব কার্যক্রম সফলকাম হয়নি বলে মনে করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার এই প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘‘অনেক প্রতিকূলতা ছিল। এখন সেসব কাটিয়ে একটা ফর্মে এসেছে।’’

আরেক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম থেকেই এটি বানচাল করতে জামায়াতের নানা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। শেষ পর্যন্ত তাদের সেসব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখন তারা ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। আর বাইরে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমনে ভীতি-আতঙ্কের সঞ্চার করছে।’’

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমও একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘‘শুধু আসামিপক্ষই নয়। এ বিচার বানচালে নানা মহলই তৎপর ছিল। তবে সেসব চরম প্রতিকূলতার মাঝেও ট্রাইব্যুনাল মোট ৩টি রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের গতি আরও বাড়বে বলেই আমরা আশাবাদী। আইনজীবীদের সহযোগিতা পেলে ট্রাইব্যুনাল আরও এগিয়ে যাবে।’’

টার্গেট যখন বিচারপতি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে বিচারকাজ থেকে সরাতে ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একটি আবেদন করেন। ১৯৯২ সালে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ১৯৯৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে একটি গণতদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন- এসব কারণ দেখিয়ে আপত্তি তোলা হয় আবেদনটিতে। যদিও তখন তিনি বিচারপতি ছিলেন না, তারপরও নিজামুল হকের স্বেচ্ছায় অপসারণ দাবি করে আবেদনটি করেন সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

১১ ও ১৩ নভেম্বর আবেদনের ওপর দীর্ঘ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু চেয়ারম্যানকে নিয়েই আবেদন, সেহেতু তিনি শুনানি- আদেশের দিনগুলোতে এজলাসে বসেননি। ১৪ নভেম্বর এ আবেদনের নিষ্পত্তি করে দেন ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারক। বিষয়টি তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এবং এ বিষয়ে তারা কোনো রায় দিতে পারেন না বলে উল্লেখ করেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ও একেএম জহির আহমেদ।

সুপ্রিম কোর্টের বিএনপি ও জামাতপন্থী সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাঈদীর করা আবেদনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন। সাঈদীর এ আবেদনের কোনো আইনগত বৈধতা নেই বলে আদালতে বক্তব্য তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর হায়দার আলী।

অন্যদিকে একই বিচারপতি ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে গোলাম আযমের আইনজীবীরা গত বছরের ৩০ মে মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের আবেদন করেন। ৬ জুন এ আবেদনের শুনানি শেষে ১৮ জুন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
মারাত্মক অসদাচারণ

তবে বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ চূড়ান্ত অসদাচারণ করার সুযোগ গ্রহণ করেন তার কথিত স্কাইপে কথোপকথনের সংবাদ প্রকাশের পর। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ করেছেন, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগের পর থেকে মামলার পুনর্বিচারসহ এমন সব আবেদন করা হতে থাকে, যাতে করে শুধু বিচারপতি নাসিমই নন, অন্য বিচারপতিরাসহ পুরো ট্রাইব্যুনালেরই মানহানির অপচেষ্টা চালানো হয়। একই সঙ্গে পুরো আদালত ব্যবস্থা, বিচারিক প্রক্রিয়া ও আইনকেই সঙ্কটের মুখে ফেলার অপপ্রয়াস চালানো হয়।

ট্রাইব্যুনালও এসব মানহানিকর আবেদনের বিষয়ে চরম উষ্মা প্রকাশ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন।

এ বিষয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম একাই চারটি আবেদন করেন। এর মধ্যে তিনি গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের কথিত স্কাইপি সংলাপের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারপতির সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা, কিংবা তারাও এ ধরনের সংলাপ করেছিলেন কিনা- তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে আবেদন করে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে চরম ধৃষ্টতাও দেখান। এ জন্য অবশ্য তিনি গত ১৪ জানুয়ারি বিচারিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ট্রাইব্যুনালের জারি করা কারণ দর্শাও (শো’কজ) নোটিশের জবাবে গত ৭ মার্চ অবশ্য ব্যারিস্টার ফখরুল ট্রাইব্যুনাল-১ এর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ৮ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেন, ‘‘একজন আইনজীবী হিসেবে বিচারপতিদেরকে মামলা কিভাবে পরিচালনা করতে হবে, তা জানার এখতিয়ার তার (ব্যারিস্টার ফখরুল) নেই। তার এ আবেদন বিচারিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সমান। যে প্রশ্ন তিনি তুলেছেন, তা অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই তোলা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতিদের সম্পর্কে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রশ্ন তোলায় জনমনে হাইকোর্টের বিচারপতি ও ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে জনমনে অবিশ্বাস তৈরি হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের স্বাধীন অবস্থান ক্ষুন্ন হতে পারে।’’

একই দিন (২৬ ডিসেম্বর) বিচারপতি নিজামুল হক ‘স্কাইপি কেলেঙ্কারি’র সঙ্গে জড়িত কিনা তা ট্রাইব্যুনালে এসে জবাব দেওয়ার জন্য তাকে সমন জারি এবং ট্রাইব্যুনাল-১ এর অন্য দুই বিচারপতিও এ ধরনের সংলাপে জড়িত কিনা- সে বিষয়ে ব্যাখ্যা-প্রমাণ দেওয়ার জন্য আরো একটি আবেদনও করেন ব্যারিস্টার ফখরুল। এর আগে ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের অপসারণ চেয়ে ও ২৪ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে আরও দু’টি আবেদন করেন ওই আইনজীবী। বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সঙ্গে তাদের নাম আসার অভিযোগ তুলে এসব আবেদন করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল এসব আবেদনের বিষয়ে চরম উষ্মা প্রকাশ করেন ১ ও ২ জানুয়ারি শুনানির দিনে। পরে অবশ্য ৩ জানুয়ারি তিনি ৩টি আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন জানান ব্যারিস্টার ফখরুল। ট্রাইব্যুনাল ‘উত্থাপিত হয়নি’ মর্মে দু’টি আবেদন খারিজ করলেও দুই বিচারপতিকে নিয়ে করা আবেদনটিকে গুরুতর অসদাচারণ বিবেচনা করে এটির বিষয়ে তাকে অভিযুক্ত করেন। আর ৭ মার্চই রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটরের বিবেচনায় ছেড়ে দিয়ে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের অপসারণ চেয়ে করা আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দেন ট্রাইব্যুনাল।

আইনজীবী নিষিদ্ধ
এছাড়াও দুই ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে নানা ধরনের অসদাচারণ, আদালত অবমাননার অভিযোগ, ট্রাইব্যুনাল বর্জন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিতির মাধ্যমে বিচার বিলম্বিত করার অভিযোগ ওঠে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনাল এসব ঘটনায় সতর্ক করে দেওয়া, শো’কজ নোটিশ জারি ও জরিমানা এমনকি একজন আইনজীবীকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে নিষিদ্ধ পর্যন্ত করেন।

ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামই এ ব্যাপারে বেশি অভিযুক্ত হন। অন্যদের মধ্যে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আলামীন, অ্যাডভোকেট এইচএম আহসানুল হক হেনাও ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে অসদাচারণের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।  

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে তার আদালত অবমাননাকর আচরণ ও বর্জনের জন্য গত বছরের ৬ নভেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এজলাস কক্ষে নিষিদ্ধ ও মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল-১। কয়েকবার তিনি ও তার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা এসব বিষয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করলে ২৩ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এজলাস কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তিনি মামলার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না বলে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ১৫ জানুয়ারি আদালত অবমাননাকর আচরণ থেকে ক্ষমা করলেও তাকে সতর্ক করে দেন ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা বা অন্য কোনো অসদাচারণের অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানিয়ে রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।  

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দু’টি অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে গত বছরের ২৩ অক্টোবর সকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী মিছবাহুর রহমানের জেরাকালে তাজুল ইসলাম রাগ করে আদালত কক্ষ ত্যাগ করেন। এতে ট্রাইব্যুনাল-১ অ্যাডভোকেট তাজুলের বিরুদ্ধে প্রথম দফা আদালত অবমাননার অভিযোগে ‘কারণ দর্শাও নোটিশ’ জারি করে ৫ নভেম্বরের মধ্যে তাকে নোটিশের জবাব দিতে বলেন।
  
এ অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তাজুল ইসলাম দ্বিতীয় দফায় আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হন ৬ নভেম্বর। আগের দিন ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এর প্রধান ফটক থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাফাই সাক্ষীকে সাদা পোশাকের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন জামায়াতের আইনজীবীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন জামায়াতের আইনজীবীরা রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলিকে ‘মিথ্যুক’ বলাসহ বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ও চিৎকারে ট্রাইব্যুনাল কক্ষ উত্তপ্ত করে তোলেন। এ সময় ‘সাক্ষী অপহরণের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে’ বলেও সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন তারা।

এসব মারাত্মক অসদাচারণের কারণেই তাজুল ইসলাম নিষেধাজ্ঞার শাস্তি পান। একই সঙ্গে ৬ নভেম্বর তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আলামীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ১১(৪) ধারা অনুযায়ী ‘কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না’ এবং ‘তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না’ জানতে চেয়ে রুল জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

আদালত অবমাননাকর আচরণ ও বর্জনের জন্য প্রতিটি ধার্য তারিখেই কয়েক দফা লিখিত ও মৌখিকভাবে ট্রাইব্যুনাল-১ এর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আলামীন এবং তাদের পক্ষের আইনজীবীরা।

১৫ জানুয়ারি তাজুলের সঙ্গে অন্য দুই আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আলামীনকেও সতর্ক ও ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেন, “আমরা প্রতিদিনই এজলাস কক্ষে উপস্থিত অনেক আইনজীবীর মুখ চিনি, কিন্তু তাদের নাম জানা না থাকায় আদেশে তাদের নাম উল্লেখ করা হলো না। কিন্তু তাদের সতর্ক করে দেওয়া হলো।”

একই সঙ্গে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীকেও সতর্ক করে দেন আদালত।

আদেশে ট্রাইব্যুনাল-১ বলেন, “তারা যে আচরণ করেছেন সেটা সিসিটিভিতে আমরা দেখেছি। জামায়াতের আইনজীবীরা রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলিকে ‘মিথ্যুক’ বলেছেন, যা আদালতের ভাষা নয়, আদালতে এ ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হতে পারে না।”

এসব বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আদালতের সঙ্গে অবমাননাকর ও অসদাচারণ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জামায়াতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তাজুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমাকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ছিল বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ‘মনগড়া’। মনে রাখতে হবে, আমাকে যিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনিই ‘স্কাইপি কেলেঙ্কারি’র দায়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর তার স্থলাভিষিক্ত বিচারপতি আমার ওপর আনা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আমাকে ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।’’ 

বিশিষ্ট নাগরিকও মিথ্যুক!
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আদালতের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট এইচএম আহসানুল হক হেনার বিরুদ্ধে শো’কজ নোটিশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তারও আগে ১৫ মে সাকার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে সাক্ষ্যদান শেষে ট্রাইব্যুনালে এবং পরে সাংবাদিকদের কাছে কয়েক দফা ‘মিথ্যুক’ বলায় ব্যারিস্টার ফখরুলকে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে না, সে ব্যাপারেও ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ জারি করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। ব্যারিস্টার ফখরুল ওই দু’দফায় নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাকে সতর্ক করে ক্ষমা করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে সাক্ষী ড. আনিসুজ্জামানের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করেন ফখরুল। আর অ্যাডভোকেট এইচএম আহসানুল হক হেনাও ক্ষমা প্রার্থনা করে পার পান।


পুনর্বিচারের আবেদনে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসপ্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে তার পদত্যাগের পর একে একে ৫টি মামলার পুনর্বিচারের আবেদন জানান আসামিপক্ষ। এ আবেদন ও তার শুনানির মধ্য দিয়ে তারা-বিচারিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরির চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল-১ এ ২৩ ডিসেম্বর সাঈদীর মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এর পর একে একে ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন জানানো হয়।

শুনানি শেষে গত ৩ ও ৭ জানুয়ারি এসব আবেদন খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল। ১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন
একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

বিদেশি সাক্ষী, আইনজীবী!
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ আইনে বিদেশি সাক্ষী ও আইনজীবীদের বিধান না থাকলেও জামায়াতের আইনজীবীদের পক্ষে বার বার বিদেশি আইনজীবী আনার চেষ্টায় আবেদন করা হয়। বার কাউন্সিল বা সরকারের পক্ষ থেকে এসব আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। অনুমোদনবিহীন ভাবে একবার কয়েকজন বিদেশি আইনজীবী এদেশেও চলে আসেন। 

রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, শুধু তাই নয়, ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমে বিদেশি ৩ জন আইনজীবীকেও নাক গলানোর কলঙ্কিত নজির সৃষ্টি করেন আসামিপক্ষ। অপকর্মটি করেছিলেন জামায়াত নিযুক্ত(!) তিন বিদেশি আইনজীবী যুক্তরাজ্যের ‘নাইন-বেডফোর্ড রো’ নামের চেম্বারের স্টিভেন কে (কিউসি), জন ক্যামেহ (ব্যারিস্টার) এবং টোবি ক্যাডম্যান (ব্যারিস্টার)।

ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্বেচ্ছা-অপসারণ দাবি করে সাঈদীর আইনজীবীর আবেদনের বিষয়ে শুনানি ছিল ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর। যেহেতু চেয়ারম্যানকে নিয়েই আবেদন, সেহেতু তিনি শুনানির দিন এজলাসে বসেননি। বিষয়টি যখন এমনিতেই বিচারাধীন এবং শুনানির জন্য ধার্য, তখন হঠাৎ ৯ নভেম্বর উপরোক্ত তিন ব্রিটিশ আইনজীবীর স্বাক্ষরে সরাসরি চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠিতে তাকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়। শুধু তাই নয়, সেই চিঠির অনুলিপি দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকার কাছেও কোনো পৌঁছে যায়!
ট্রাইব্যুনাল বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, এভাবে সরাসরি কোনো বিচারকের কাছে বিচার্য বা বিচারাধীন বিষয়ে চিঠি লেখা বা যোগাযোগ করা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। এ ধরণের আচরণ কেবল বাংলাদেশের বিচারালয়ের প্রথাতেই অবমাননা হিসেবে বিবেচিত না, সভ্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিষয়টি এভাবেই দেখা হয়। এমনকি যুক্তরাজ্যেও, ওই তিন আইনজীবী যে দেশের। বিষয়টির ওপর ট্রাইব্যুনাল একটি আদেশ জারি করেন, যেখানে ওই তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণের জন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বার কাউন্সিলের Bar Standards Board এ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়। এবং সে মর্মে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অন্যদিকে গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিতে দু’জন বিদেশি সাক্ষী আনতে তার আইনজীবীরা বার বারই নানা কায়দায় নানা আবরণে আবেদন করলেও ট্রাইব্যুনাল তার অনুমোদন দেননি।

জামায়াতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘যেসব বিষয়ে এই ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে, তার সবই আন্তর্জাতিক আইনের উপাদান। আন্তর্জাতিক অঙ্গণের অভিজ্ঞতা ছাড়া সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়। আমরা বিদেশি আইনজীবী আনতে পারলে তারা ট্রাইব্যুনালকে অন্তত সহযোগিতা করতে পারতেন। কারণ, আমাদের দেশে এই বিচারের জন্য অভিজ্ঞ কোনো আইনজীবী বা বিচারক নেই।’’

তিনি একই সঙ্গে এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকদেরও আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া উচিৎ ছিল বলে দাবি করেন।

ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪২নং ধারা উল্লেখ করে তাজুল দাবি করেন, ‘‘এ আইনেই আছে, বিদেশি আইনজীবী ও সাক্ষী আনা যাবে।’’ 
তবে তার এ দাবি সঠিক নয় বলে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সরকার ও আইন অনুমোদন দিলে তারা আসতে পারবেন। সেই অনুমোদনের দায়িত্ব ট্রাইব্যুনালের নয়।’’
হাজার হাজার সাফাই সাক্ষী!

অবিশ্বাস্য রকম লম্বা সাফাই সাক্ষীর তালিকা দিয়ে বিচারিক কার্যক্রমকে কেবল বিলম্বিতই নয়, কটাক্ষ ও হেয় করারও হাস্যকর অপচেষ্টা করেন আসামিপক্ষ। এর মধ্যে সাফাই সাক্ষীর তালিকায় গোলাম আযমের পক্ষে ২ বিদেশিসহ ২ হাজার ৯৩৯ জন, মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে ১০ হাজার ১১১ জন, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পক্ষে ১ হাজার ৩৮৫ জন, মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে ১ হাজার ৩৫৭ জন, আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে ৯৬৫ জন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে ১ হাজার ১৫৩ জন ও আব্দুল আলীমের পক্ষে ৩ হাজার ৩২৮ জন নাম দেওয়া হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে অবশ্য তালিকায় নাম ছিল ৪৮ জনের।

ট্রাইব্যুনাল এসব তালিকার কয়েকটি বাতিল করে সাফাই সাক্ষী সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।  

অভিনব আবেদনের বহর

নানা ধরনে, নানা আবরণে অসংখ্য আবেদন করে গত ৩ বছরে আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের বিরাগভাজন হয়েছেন বেশ কয়েকবার। এসব কারণে ট্রাইব্যুনাল আসামি বা তাদের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও আইন ও বিধি-বিধানবিরোধী এসব আবেদন করা, খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেও একই ধরনের আবেদন বারবার করা থেকে বিরত হচ্ছেন না তারা- এমন অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষেরও। 

এক এক আসামির পক্ষে কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক করে আবেদনের রেকর্ড গড়া হয়েছে গত ৩ বছরে। এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীই আবেদন করেন ১৩২টি, যার মধ্যে ৮ বার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। সর্বশেষ রায় হয়ে যাওয়ার পরেও ২০১০ সালে পিরোজপুরের সদর ও জিয়ানগর থানায় দায়েরকৃত দু’টি যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাঈদীর জামিনের (!) আবেদন করা হয় ২০ মার্চ। ২১ মার্চ শুনানি শেষে এখতিয়ার বহির্ভুত উল্লেখ করে আবেদনটি খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল-১।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কয়েকটি আবেদনের কথাও,
যেগুলো ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্যের আগে আগে ৫ ডিসেম্বর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাক্ষ্য ও ফৌজদারি আইন প্রয়োগ, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ, ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তদন্তে রাষ্ট্রপক্ষের মতো আসামিপক্ষকেও ১১ মাস সময় দেওয়া, মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সনদের শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা।

এদিকে বার বার একই আবেদন করায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৩ জানুয়ারি ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। কাদের মোল্লার পক্ষে ৪র্থ বারের মতো আরো ৬ জনকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। এর আগে গত ৫ নভেম্বর কাদের মোল্লার পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আসামিপক্ষের দাখিল করা ৯৬৫ জনের তালিকা থেকে ৬ জন সাফাই সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১১ নভেম্বর সাফাই সাক্ষীর সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে ১২ জন করার আবেদন জানান কাদের মোল্লা। ১২ নভেম্বর শুনানি শেষে ওই আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২৬ নভেম্বর এ আদেশের রিভিউ চেয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। ২৯ নভেম্বর সে আবেদনও খারিজ হয়। ২৪ ডিসেম্বর ফের আরও ৬ জন সাফাই সাক্ষী চেয়ে আবেদন করেন কাদের মোল্লা। ২৬ ডিসেম্বর ফের আবেদন খারিজ হয়।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছেন, ‘‘অভিনব, আইনবিরোধী এমনকি কিছু কিছু উদ্ভট মিলিয়ে এসব আবেদনই প্রমাণ করে, তারা আবেদনগুলো করছেন কোনো কিছু পেতে নয়। স্রেফ বিচারিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত-বিলম্বিত করতেই এগুলো করা হচ্ছে।’’

তবে রাষ্ট্রপক্ষের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘একাধিক আবেদন করার অর্থই বিচার বিঘ্নিত করা নয়। বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই এগুলোর শুনানির প্রয়োজন পড়ে। যারা এগুলোকে বিচার বিঘ্নিত করার প্রয়াস বলে থাকেন, তারা আসলে জানেন না, কিভাবে বাইরের দেশের ট্রায়ালগুলো পরিচালিত হয়। তাদের এ বিষয়ে বিশদ ধারণা রাখা উচিত।’’

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আসামিপক্ষ যে সকল আবেদন জমা দিয়েছেন, তার প্রতিটিই যৌক্তিক। যারা এসব আবেদনকে অযৌক্তিক বলছেন, তারা এমন একটি আবেদন দেখান, যা অপ্রয়োজনীয়। বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটি অমূলক।’’

ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিতি ও জরিমানা
নানা অজুহাতে বিশেষ করে হরতাল ও রাজৈনিতিক পরিস্থিতির কথা বলে ট্রাইব্যুনালে বারংবার ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত ছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এমনকি তারা তাদের সাফাই সাক্ষীদেরও হাজির করতে বারবার ব্যর্থ হয়ে সময়ের আবেদন জানাতে থাকেন। এসব কারণে আসামি বা তাদের আইনজীবীদের কয়েক দফা জরিমানা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। 

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে জেরার নির্ধারিত দিনে ট্রাইব্যুনালে না আসায় গত ১২ মার্চ আলীমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মোঃ খলিলুর রহমানকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল-২। আইনজীবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ মার্চ এ জরিমানা আলীমকেই পরিশোধের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগেও গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একই কারণে আলীমের আইনজীবীদের ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল।

অন্যদিকে গোলাম আযমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামকে ১২ মার্চ ১ হাজার টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করতে ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় তাকে জরিমানা করা হয়। ১৮ মার্চ নির্ধারিত এক ঘণ্টার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে ট্রাইব্যুনালে না আসায় গোলাম আযমের অপর আইনজীবী ইমরান সিদ্দিকীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন একই ট্রাইব্যুনাল।  

ট্রাইব্যুনাল এসব জরিমানার আদেশে বলেন, ‘‘তারা বার বার এটা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হচ্ছে।’’

এদিকে বারবার একই আবেদন করায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত ৩ জানুয়ারি ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল।

‘সেফ হাউস’ বিতর্ক
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে গত বছরের ২৯ মার্চ রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সে রায় ফের বিবেচনার জন্য ৯ মে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন সাঈদীর আইনজীবী। ২২ মে এ বিষয়ে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

৩ জুন ফের শুনানির সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সেফ হাউসের (ঢাকায় যেখানে সাক্ষী এনে রাখা হতো) নামে ৬০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট আদালতে দাখিল করে দাবি করেন, ‘‘সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা কোর্টে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতকে প্রতারিত করেছেন। অনেক সাক্ষী তাদের হেফাজতেই ছিলেন এবং সেফ হাউসের এসব কাগজপত্রে তার প্রমাণ রয়েছে।’’

রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী ট্রাইব্যুনালকে জানান, ‘‘সেফ হাউস বলতে আমাদের কিছু নেই। তারা সেফ হাউসের নামে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন এ রিপোর্ট আমাদের না। হতে পারে এটি তাদের প্রডাকশন।’’

সেফ হাউজের কথিত এসব ডকুমেন্টকে তিনি জাল বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘ষড়যন্ত্রের কালোহাত কতোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, তা এ থেকেই বোঝা যায়।’’

সাক্ষী যখন বৈরি
একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত দু’জন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দুই সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ায় সাক্ষীসহ বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসছে।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী হিসেবে গত বছরের ২৩ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের তালিকাভুক্ত সাক্ষী গণেশ চন্দ্র সাহা। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ ভাগীরথী সাহার ছেলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দালালদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন ভাগীরথী।
অভিযোগ ছিল, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হাতে তিনি নিহত হন। কিন্তু ভাগীরথী সাহার ছেলে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী তার মাকে হত্যা করে। সাঈদী তাকে হত্যা করেননি। ওই হত্যাকাণ্ডের সময় সাঈদী সেখানে ছিলেন না। অথচ গণেশ চন্দ্র সাহা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তার মাকে হত্যার ঘটনায় সাঈদী জড়িত ছিলেন। 

প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘‘মামলা চলাকালে আমরা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না, আসামিপক্ষ থেকে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে তাদের সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের তালিকাভুক্ত সাক্ষী হয়েও আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে গণেশের সাক্ষ্য দেওয়া ওই অভিযোগ প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’’

তিনি বলেন, গণেশ চন্দ্র সাহাকে টাকার বিনিময়ে আসামিপক্ষ সাক্ষ্য দেওয়ান।

অন্যদিকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সাহেরা বেগম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ টুনটুনি ওরফে পল্লবের ভাবি। পল্লবকে ঢাকার নবাবপুর রোড থেকে অপহরণ করে কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং কাদের মোল্লা তাকে হত্যা করে লাশ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন- এমন অভিযোগ ছিল। অথচ পল্লবের ভাবি সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ট্রাইব্যুনালকে জানান, কাদের মোল্লার নাম তিনি কখনো শোনেননি। এমনকি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গেও ওই সাক্ষীর কখনো কথা হয়নি।

রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, ওই দু’জন সাক্ষীর আসামির পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগ প্রমাণ করে যে, তারা নিরাপত্তাহীনতার অভাবে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা আসামিপক্ষের হুমকি, প্রলোভন, ভয়ে অথবা অর্থের বিনিময়ে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। জামায়াত সাক্ষীদেরকে গোপনে লুকিয়ে রেখে টাকা-পয়সা দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াচ্ছে। এমনকি তারা আমাদের সাক্ষীদেরকে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে দেশত্যাগেও বাধ্য করছে বা করার চেষ্টা করছে।’’

‘‘ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর তালিকা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। সাক্ষীরা গরিব ও নিরীহ গ্রামবাসী হওয়ায় ভয়ে তারা ঘাতকদের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হন।’’

‘‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, সাঈদীর মামলার দুজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ভারতে চলে গেছেন। তাদের ভয় দেখানো হয়েছে। নিরাপত্তা নেই ভেবে তারা দেশ ছেড়েছেন।’’

No comments

Powered by Blogger.