পাহাড়ে সৌন্দর্যের লীলাভূমি- খাগড়াছড়ি ॥ পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন, নানা বৈচিত্র্য, পাহাড়ী ঝর্ণাধারা আর সবুজের সমাহারপূর্ণ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। একাধিক পর্যটন স্পটসমৃদ্ধ এ জেলায় রয়েছে আলুটিলার সুড়ঙ্গ পথ, রিছাং ঝর্ণা,
নুনছড়ি দেবতা পুকুর, দীঘিনালায় উপজাতীয়দের সংস্কৃতিসমৃদ্ধ মানিক্যাদীঘি, মাটিরাঙ্গায় শত সহস্র বছরের পুরনো মায়ের মমতা ও মাতৃত্ববোধের অপরূপ দৃশ্য বটতলী, সর্বোচ্চ বৌদ্ধমূর্তি সম্বলিত পানছড়ি অরণ্য কুটির, আলুটিলা আলোক ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার, দীঘিনালা শিবছড়ি পাহাড়, জেলা সদরে পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি ও দৃষ্টি নন্দন কর্নেলের বাগান। ঐতিহাসিক লোগাং ধুদুকছড়া, শুকনাছড়ি রহস্যে ঘেরা মন্দির। মহালছড়িতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরউত্তম ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের শাহাদাত বরণের স্থান ও রামগড়ে সমাধিস্থল, ঝর্ণা টিলায় মনোরম পাহাড়ী ঝর্ণা এবং প্রায় ১৬ শ' ফুট উঁচুতে অবস্থিত ভগবান টিলা ও জেলার রামগড়ে রয়েছে বিডিআর'র এর জন্মস্থান এবং প্রথম সদর দফতর, কৃত্তিম পর্যটন লেক, ঝুলন্ত সেতু, বনবীথি মৎস্য লেক ও বাগান। এছাড়াও চা বাগান পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান। তবে খাগড়াছড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পর্যটন স্পটগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত না করায় এবং পর্যটক সুযোগ সুবিধা না থাকায় পর্যটকরা খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সমতল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট পাহাড়ের চূড়ায় নুনছড়িতে রয়েছে প্রায় ৫ একর আয়তনে এক অলৌকিক দীঘি। নুনছড়ি দেবতা পুকুর নামে স্রষ্টার এক আশ্চর্য নিদর্শন এ দীঘি। যা সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই সহস্রাধিক ফুট উপরে পানির অবস্থান। শীত গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সমান পানির অবস্থান সত্যিই অকল্পনীয় যা না দেখলে অবিশ্বাস্যই থেকে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে অবস্থিত এই জলাধারপূর্ণ দীঘি কল্পনাকেও হার মানায়। স্থানীয় (ত্রিপুরা সমপ্রদায়) লোকজনের কাছে এটি মাতাই পুকি বা দেবতা পুকুর নামে পরিচিত। সরেজমিনে গেলে স্থানীয় লোকজন জানান, সহস্র ফুট উঁচুতে এ পুকুরের পানি কখনও শুকায়না। স্থানীয় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মানত করেন এ দেবতা পুকুরকে ঘিরে।
অন্যদিকে বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলায় যেসব পর্যটন স্পট রয়েছে তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে খাগড়াছড়ি আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র। প্রায় সিকি কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ রহস্যময় সুড়ঙ্গ পথে মশাল জ্বালিয়ে সুড়ঙ্গের এক প্রানত্ম থেকে অপর প্রানত্মে যেতে হয়। সাহসী পর্যটকদের আকর্ষিত ও রোমাঞ্চিত করে এ সুড়ঙ্গ পথ। পাহাড় চূড়ার মধ্যে স্রষ্টার অপার সৃষ্টি রহস্যময়ী আলুটিলা সুড়ঙ্গকে ঘিরে পর্যটকদের রয়েছে বিশেষ কৌতুহল। অপরূপ ধাচে প্রকৃতির সৃষ্টি আলু টিলার এ রহস্যময়ী সুড়ঙ্গ সত্যিই অবাক করার মতো। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বা গুহা। এ গুহা ও গুহার শীর্ষদেশ পাহাড় থেকে নয়নাভিরাম খাগড়াছড়ি শহরের দৃশ্য দেখা যাওয়াকে কেন্দ্র করে সরকারী ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে জেলার একমাত্র পর্যটন কেন্দ্র।
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র থেকে একটু দূরেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে গড়া রিছেং বা পাহাড়ী পানির ঝর্ণা বা শিলছড়ি ঝর্ণা। প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি পাশাপাশি দুটি ঝণর্া রয়েছে। এ ঝর্ণাধারা অনায়াসেই পর্যটকদের কাছে টানে। ঝর্ণার পানি স্পর্শ করলে মুহূর্তে মনপ্রাণ শীতল হয়ে যায়। পবিত্র হয়ে উঠে আত্মা। খাগড়াছড়িতে আসা পর্যটকদের দৃষ্টিতে এ ঝর্ণাধারা দুটি সিলেটের মাধবকু- ঝর্ণা থেকে কোন অংশে কম নয়। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন আধুনিক কারুকাজ সজ্জিত আলুটিলা আলোক ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার। আলুটিলার একটি সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় এটি অবস্থিত। এই বিহার পর্যটকদের আকর্ষণ করবেই। অপরদিকে জেলার পানছড়িতে রয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৌদ্ধমূর্তি সংবলিত অর্যণ কুঠির। এ কুঠিরে স্থাপিত বুদ্ধ মূর্তির উচ্চতা প্রায় ৪৭ ফুট। এটিকে বাংলাদেশ তো বটেই এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বুদ্ধ মূর্তি বলে ধারণা করা হচ্ছে। দীঘিনালায় রয়েছে তৎকালীন রাজা মানিক্যের তৈরি দীঘি যা রাজা মানিক্যার দীঘি নামেই পরিচিত। মানিক্য রাজার দীঘি থেকে দীঘিনালা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে ঝুলনত্ম সেতু ও নৃগোষ্ঠীর জীবন ধারা উপভোগের অপূর্ব সুযোগ। দীঘিনালা শীবছড়ি পাহাড়ে ৬০ ফুট চওড়া ২টি স্বর্প আকৃতির কৃষ্ণের শিলা আসন ও ২টি কৃষ্ণের গরম্নর বাহন রয়েছে। জেলা সদরে পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে ইদানীং নাটকসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টারির শূটিং হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য আরও আছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মানিকছড়ি মং চীপের (স্থানীয় ভাষায় রাজা) রাজবাড়ি ও দৃষ্টিনন্দন কর্নেলের বাগান। জেলার রামগড়ে রয়েছে ১৭৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সীমানত্ম রী বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস এর জন্মস্থান ও প্রথম সদর দফতর। রামগড়ে পর্যটকদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে কৃত্রিম পর্যটন লেক, ঝুলনত্ম সেতু, বনবীথি মৎস্য লেক ও বাগান। এছাড়াও খাগড়াছড়ির শেষ প্রানত্মে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ঘেঁষে ডলু চা বাগান ও রামগড় চা বাগান পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কালের সাী পার্বত্য শানত্মি চুক্তির একাধিক সংলাপের ইতিহাসসমৃদ্ধ ও পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র জমাদানের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজরিত লোগাং ধুদুকছড়া। যার মনোরম দৃশ্য দেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ধুদুকছড়াকে পর্যটন স্পট হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং দ্রম্নত আধুনিক মানসম্পন্ন আনত্মর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রম্নতি দেয়। মহালছড়ির শুকনাছড়ি পাহাড়ে রয়েছে রহস্যে ঘেরা পুরানো মন্দির। খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরউত্তম ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের শাহাদাত বরণের স্থান ও রামগড়ে সমাধিস্থল। পানছড়িতে রয়েছে তবলছড়ি সড়কে ঝর্ণাটিলায় মনোরম পাহাড়ী ঝর্ণা এবং পানছড়ি ও মাটিরাংগা উপজেলার শেষ প্রানত্মে রয়েছে প্রায় ১৬শ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ভগবান টিলা। যার উপর দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজ পাহাড়-বন বনানী ঘেরা প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্র্দয দেখে। সীমানত্মবতর্ী এ স্থান থেকে ভারত বাংলাদেশকে একই দৃষ্টিতে দেখা যায়। ভগবান টিলা উৎসাহী পর্যটকদের জন্য যেন প্রকৃতির আনত্মর্জাতিক পর্যবেণ টাওয়ার। এছাড়াও কথিত আছে, সু-উচ্চ ভগবান টিলায় উঠে ডাকলে স্বয়ং ভগবান সাড়া দেন।
মাটিরাংগা উপজেলার আলুটিলা বটতলীতে কয়েক শতবষর্ী একটি বট বৃরে বোগলে ডজনখানেক বাচ্চা বট গাছ আগলে রেখেছে মায়ের মমতা ও মাতৃত্ব বোধ দিয়ে। ২০০৩ সালে উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এখানে মিনি পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামো তৈরি করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলা শহরের প্রবেশমুখে অপূর্ব র্নিমাণশৈলীর পর্যটন মোটেল, রয়েছে খাগড়াছড়ি গেট, জিয়া ভাস্কর্য, দৃষ্টি নন্দন মু্যরাল, শত বছরের য়ংড বৌদ্ধ বিহার ও স্বপ্নের নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন নয়ানাভিরাম দৃশ্য, যা খাগড়াছড়ি জেলা শহরের সৌন্দর্য ও জৌলুস বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন ১৩টি নৃগোষ্ঠী সমপ্রদায়ের বসবাসের জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিকট এক আকর্ষণীয় স্থান। পার্বত্য অধিবাসীদের কৃষ্টি কালচার সত্যিই মুগ্ধ করে পর্যটকদের। পার্বত্যাঞ্চলে বাঙালী সমপ্রদায়ের পাশাপাশি রয়েছে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাওতাল, তঞ্চঙ্গ্যা, মোরং, পাংখোয়া, লুসাই, বোম, খুমি ও চাক নামক একাধিক নৃ-গোষ্ঠীর পারস্পরিক সহাবস্থান।
- জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি

No comments

Powered by Blogger.