জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সুপারিশ ও কিছু কথা by মোঃ মতিউর রহমান

জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত  সময় দিয়েছেন আদালত। পত্রপত্রিকায় এ খবর পড়ে অনেকের মতো আমার মনে কিছু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে।
জুড়িশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং তাদের সুপারিশ কি নিরপেক্ষ ও নির্মোহ ছিল? সরকার কোনো কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি মানতে বাধ্য কি না। আদালত সরকারকে কোনো কমিশন বা কমিটির সুপারিশ মানতে বাধ্য করতে পারেন কি না। আদালতই বা একটি নির্দিষ্ট সার্ভিসের জন্য আলাদা পে-কমিশন গঠনে বাধ্য করতে পারেন কি না। আর পারলেও সেই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আদালত এহেন মনোভাব পোষণ করছেন কেন? এতে কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ প্রদর্শিত হচ্ছে কি না। আর বিচার ও নির্বাহী বিভাগের কাজের যে স্বতন্ত্রীকরণ সংবিধানে বিধৃত আছে সেই নীতি সমুন্নত থাকছে কি না। এসব প্রশ্ন আজ বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। সরকার এ বিষয়গুলো আদালতে যথাসময়ে তুলে ধরেছে কি না জানা নেই।

সাধারণত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতা নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট পদের কাজের প্রকৃতি বা ধরন, পদের মর্যাদা, কাজের পরিমাণ, কর্ম অধিক্ষেত্র বা নিয়ন্ত্রণ পরিধি প্রভৃতি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। জেলা জজ এবং অন্য জজরা জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত। এক সময় সহকারী জজগণ উপজেলাপর্যায়েও কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে জেলায় তুলে নেয়া হয়। জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তা জেলা জজকে জাতীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা একজন সচিব কিংবা সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমান বেতন দেয়ার প্রশ্ন কেন আসছে তা বোধগম্য নয়। একটি ক্যাডার বিভাগের কোন ব্যাচের কতজন কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হন এবং কতজনই বা গ্রেড-১ এর বেতন পান? কিন্তু সহকারী জজদের সবাই ন্যূনতম জেলা জজ হিসেবে উন্নীত হন। একটা কথা বলা হচ্ছে, জেলা জজ পদ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ। এ কথাটা কতটুকু সত্য? জেলা জজদের মধ্য থেকে হাইকোর্টের ৩৩ শতাংশ শূন্য পদ পূরণ করা হয়। অর্থাৎ তারা হাইকোর্টের বিচারকদের বেতন ও মর্যাদা পান। তাতে অন্যান্য ক্যাডার বিভাগের সাথে একটা বৈষম্য হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে জেলা জজ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদÑ এ কথা ধোপে টেকে না। তা ছাড়া তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে জেলা জজ বিচার বিভাগরে সর্বোচ্চ পদ, তাহলে তো সেই যুক্তিতে সব বিভাগের প্রধান পদটিকেও (সমবায়, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিভাগ) গ্রেড-১ ভুক্ত করতে হয় এবং সেই দাবি ওঠা মোটেও অস্বাভাবিক নয় এবং তা উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। তখন তো বেতন নির্ধারণের মৌলনীতি (কাজের ধরন, পদমর্যাদা ও কাজের পরিমাণ প্রভৃতি) প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে কিংবা তা অকার্যকর হয়ে যাবে। তখন আদালতের ভূমিকা কী হবে তাও তো দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। উচ্চ আদালত যদি এভাবে বিচার বিভাগের বেতনভাতা ও পদমর্যাদা নির্ধারণে সরকারকে বাধ্য করে তাহলে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণের মৌলভিত্তি বা মৌলযুক্তি (Rationale) প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।

উল্লিখিত যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে বিষয়টি আদালত কর্তৃক সার্বিকভাবে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। সে জন্য সরকার আদালতের পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করে দেখতে পারে এবং সেই সাথে আদালত অবমাননার আদেশ স্থগিত রাখার আবেদনও জানাতে পারে। আদালত এর সর্বোত্তম প্রজ্ঞা, বিবেক ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং অনুভূতি দিয়ে তা বিবেচনা করতেও পারেন। কারণ আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। আর উচ্চত আদালত হলে তো কথাই নেই। তাদেরকে অনুরাগ বা বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এর আদেশ-নির্দেশের পরিণাম ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথাও ভাবতে হয়। কারণ সমাজে সুস্থিতি বজায় রাখাও আইনের শাসনের মৌলকথা। উল্লেখ্য, ভারতীয় আইনশাস্ত্রের প্রথম দিকে ন্যায়বিচারের দু’টি ধারণা (Concept) প্রচলিত ছিলÑ একটি নীতি ও অন্যটি ন্যায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে বীর যোদ্ধা অর্জুনকে তার উপদেষ্টা কৃষ্ণ যুদ্ধের পরিণতির কথা না ভেবে তার কর্তব্য পালন করতে বললেন অর্থাৎ তিনি নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করলেন। অপর দিকে অর্জুন যুদ্ধের পরিণাম ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব তথা সম্ভাব্য হতাহতের কথা ভেবে বিচলিত হলেন এবং সেটি করা ন্যায়সঙ্গত হবে কি না সেটাই ছিল অর্জুনের প্রশ্ন। এ নিয়ে উভয়ের কথোপকথন মহাভারতের তথা ইতিহাসে এক জ্ঞানগর্ভ পাঠ হয়ে আছে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধ্য করার পরিণতি এবং সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহল শঙ্কিত। এ ক্ষেত্রে ন্যায় ও নীতি কোনোটিই প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। এখন সরকার ও আদালত শেষমেশ কী করে তা-ই দেখার বিষয়।

লেখকঃ সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

No comments

Powered by Blogger.