১ নম্বর চার্জ পল্লব হত্যার ভিত্তি শোনা কথা- কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ ঘটাননি by মেহেদী হাসান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত ৫ তারিখ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
আবদুল কাদের মোল্লাকে যে পাঁচটি অভিযোগে কারাদণ্ড দেয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যার ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে আবদুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।

রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে, এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হলো শোনা কথা। ট্রাইব্যুনালের হাতে যা এসেছে তাতে দেখা যায় আবদুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।

আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে ছয়টি অভিযোগ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তার পর প্রতিটি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের যেসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরপর আসামিপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগের পক্ষে দুই পক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে। কোন অভিযোগে কেন আসামিকে দণ্ডিত করা হলো, সাক্ষীর সাক্ষ্য কেন, কতটুকু মাত্রায় গ্রহণ করা হলো, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।

রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা : আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১ নম্বর চার্জ ছিল পল্লব হত্যার ঘটনা। এ অভিযোগটি বিশ্লেষণের শুরুতে রায়ে ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, আবদুল কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে জোর করে আবদুল কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা হয়। তার পর আবদুল কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গরা পল্লবকে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর শাহআলী মাজার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এরপর তাকে আবার মিরপুর ১২ নম্বর ঈদগাহ মাঠে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কাদের মোল্লার সহযোগী আক্তার গুণ্ডা ও অন্যরা মিলে পল্লবকে ৫ এপ্রিল হত্যা করে। পল্লব হত্যায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অপরাধ হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় চার্জে। অথবা হত্যা ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাক্ষী : রায়ে বলা হয়, পল্লব হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের একজন হলেন শহিদুল হক মামা, অন্যজন সৈয়দ আবদুল কাইউম। অন্য দিকে আসামিপক্ষে এ ঘটনায় সাক্ষ্য দিয়েছেন পল্লবের ভাবী সাহেরা খাতুন। সাহেরা খাতুন ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তবে তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য না দিয়ে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

সাক্ষী পর্যালোচনা : রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শহিদুল হক মামা পল্লবকে হত্যার জন্য আবদুল কাদের মোল্লা নির্দেশ দিয়েছেন, তা তিনি দেখেননি। অথবা পল্লবকে যে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে তা-ও দেখেননি। জেরায় সাক্ষী বলেছেন, তিনি জনতা ও যাদের তিনি চিনতেন তাদের কাছে পল্লবকে জোর করে ধরে আনা, নির্যাতন করা ও হত্যার ঘটনা শুনেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষী আবদুল কাইউমও বলেছেন, তিনি শুনেছেন কাদের মোল্লা বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে হত্যা করেছে।

সাক্ষী শহিদুল হক মামা যদিও শোনা কথা বলেছেন, তবু তিনি একজন ন্যাচারাল সাক্ষী; অন্যথায় তিনি বাড়িয়ে বলতে পারতেন যে, তিনি দেখেছেন আবদুল কাদের মোল্লা পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। তার যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকত, তা হলে তিনি বলতে পারতেন, তিনি ওই ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তা না বলে তিনি এ ঘটনায় কিভাবে ও কাদের পরিকল্পনায় ঘটানো হয়েছে, সে বিষয়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি জনতার কাছে এবং যাদের তিনি চেনেন এমন অনেকের কাছে এ ঘটনা শুনেছেন।

রায়ে সাক্ষী শহিদুল হক মামা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত তার জবানবন্দীর ভিত্তিতে। এতে বলা হয়, সাক্ষী শহিদুল হক মামা একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা। সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, আবদুল কাদের মোল্লা বিহারিরা, আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাশিম হাসবি ও নেহাল গোলাম আযমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিত।

রায়ে বলা হয় আবদুল কাদের মোল্লা যদিও একজন বাঙালি ছিলেন, কিন্তু স্থানীয় আক্তার গুণ্ডা ও বিহারি গুণ্ডাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাক্ষী শহিদুল হক মামা বলেছেন, ২৫ মার্চের আগেই ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের সময় তিনি জামায়াতের আবদুল কাদের মোল্লাসহ কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে প্রতিরোধ ও আক্রান্ত হয়েছেন। এসব কারণে আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিহারি গুণ্ডা ও আক্তার গুণ্ডাদের সাথে সাক্ষী শহিদুল হক মামার আগে থেকেই বিরোধ ছিল। ২৫ মার্চ রাতে মিরপুরেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সাক্ষী শহিদুল হক মামা রাতে শাহআলী মাজারে আশ্রয় নেন। সকালে মাজার থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পান এবং কাদের মোল্লাসহ অন্যরা তাকে ধাওয়া দেয়। রায়ে বলা হয়, জেরায় এসব বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সাক্ষী মূল্যায়ন : রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বেনামি শোনা কথার কোনো বিচারিক মূল্য নেই। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, আইনে শোনা কথা গ্রহণযোগ্য।

অভিযোগের ভিত্তি শোনা কথা : রায়ে বলা হয়েছে, আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১ নম্বর অভিযোগ পল্লব হত্যার অভিযোগের ভিত্তি হলো শোনা কথা। শোনা কথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ডিসক্রিশন, আইনে প্রদত্ত বৈধতা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতা, সংশ্লিষ্ট ঘটনা ছাড়াও সার্বিক বিষয়ে আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ পর্যায়ে। রায়ে বলা হয়, যেহেতু টেকনিক্যাল রুল অব এভিডেন্স ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, বিহারি গুণ্ডা, আক্তার গুণ্ডার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই এসব বিবেচনায় শোনা কথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, সেই সময় সেখানে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করে; তাতে কোনো বাঙালির পক্ষে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো, জোর করে পল্লবকে কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা বা কাদের মোল্লা কর্তৃক পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দেয়ার ঘটনা দেখা সহজ ছিল না। সাক্ষীর মতে, মিরপুরে তখন ৯০ শতাংশ মানুষ ছিল বিহারি। সামান্য যে ১০ শতাংশ বাঙালি ছিল। তারা ছিল ভয়ে ভীত। হঠাৎ করে বিহারি গুণ্ডা, স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালি যারা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সাথে জড়িত ছিল, তারা পাকিস্তান আর্মির সাথে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির অবতারণা করে তাতে বাঙালিরা ত্রাসের মধ্যে ছিল সেখানে। তাই সাক্ষী শহিদুল হক মামা লোকজনের কাছে পল্লব হত্যার ঘটনা শুনেছেন বলে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোনো চাুস সাক্ষী নেই বলে তার সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা যায় না।

তা ছাড়া দীর্ঘ ৪১ বছর পর এ বিষয়ে জীবিত সাক্ষী না-ও পাওয়া যেতে পারে এবং সেই সময়কার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এ ঘটনা কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নাও হতে পারে। সাক্ষী শহিদুল হক মামা মিরপুরের একজন স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত। তাই তার পক্ষে আবদুল কাদের মোল্লা ও অন্য যারা পাকিস্তানপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তাদের চেনা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা যায়।

আসামিপক্ষের সাক্ষী সম্পর্কে রায়ে যা বলা হয়েছে : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো ট্রাইব্যুনালে এসে কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি পল্লবের আপন ভাবী। এ সাক্ষী সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, তিনি একজন ম্যানেজড সাক্ষী; অর্থাৎ আসামিপক্ষ তাকে ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছে। সত্য প্রকাশ না করার জন্য, রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য ও আসামিকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার মেকানিজমের অংশ হিসেবে তাকে আনা হয়।

রায়ে আরো বলা হয়, সাক্ষী সাহেরা জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি আবদুল কাদের মোল্লার নাম জীবনেও শোনেননি। যদি এটি সত্য হয় তা হলে কাদের মোল্লা তখন এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল কি ছিল না এ বিষয়েও তার কিছু জানার কথা নয়। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সাথে সংশ্লিষ্টতা, স্থানীয় বিহারি, স্বাধীনতাবিরোধী, বাঙালি বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকায় ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার আগে থেকেই কাদের মোল্লা পরিচিত ছিলেন। কাজেই জীবনে একবারও আবদুল কাদের মোল্লার নাম না শোনার কথা মিথ্যা হিসেবে পরিগণিত।

এভাবে আরো কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে কেন আসামিপক্ষের সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয়, সে বিষয়ে। রায়ে বলা হয়েছে, যেহেতু এ সাক্ষী সত্যকে গোপন করে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন; তাই তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেয়ার কথাও অস্বীকার করেছেন। নিঃসন্দেহে এ সাক্ষী সত্য গোপন করেছেন বিশেষ করে ঘটনার সাথে আসামির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে। অন্য দিকে তার সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষের শোনা কথাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

রায়ে বলা হয়েছে, আবদুল কাদের মোল্লার সাথে স্থানীয় বিহারি এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। রায়ে উদাহরণ পেশ করে বলা হয়েছে, যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তার সাথে অভিযুক্তের সরাসরি সম্পৃক্ত বা জড়িত থাকতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, পারিপার্শি¦ক পরিস্থিতি ও ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা পেয়েছি যে, আবদুল কাদের মোল্লা ও তার বিহারি সহযোগীরা মিলে বেসামরিক নাগরিক পল্লব হত্যা পরিকল্পনা করেছে। নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। পল্লবকে যখন হত্যা করা হয়, তখন সেখানে আসামিকে উপস্থিত থাকতে হবে এমনটি অপরিহার্য নয়। রায়ে বলা হয়, তার নৈতিক সমর্থনে, জ্ঞাতসারে ও পরিকল্পনায় এ হত্যা ঘটনা ঘটে; যদিও ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। কারণ পল্লব ছিল স্বাধীনতার পক্ষের। বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত আক্রমণের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। তাই এটি একক হত্যাকাণ্ড হলেও আইনে বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও গণ্য এটি।

রায়ের শেষ দিকে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের কাছে যেসব বিষয় উত্থাপিত হয়েছে, তাতে অভিযুক্ত আবদুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছেন, সে মর্মে কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই। বরং যেটি প্রমাণিত হয়েছে সেটি হলো মিরপুরে স্বাধীনতাবিরোধী বিহারি গুণ্ডাদের সাথে তার যোগসাজশ ছিল। অপরাধ সংঘটনের আগে থেকেই তাদের সাথে তার এ সম্পর্ক ছিল।

আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ে ১ নম্বর চার্জ বা পল্লব হত্যার ঘটনাটি প্রায় ১৮ পৃষ্ঠাজুড়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী যা বলেছেন : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু গত ২ ডিসেম্বর তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে চমক সৃষ্টি করলেন। সাহেরা সেই দিন ট্রাইব্যুনালে বলেন, তার দেবর পল্লবকে আবদুল কাদের মোল্লা নয়, বরং আক্তার গুণ্ডা ও বিহারিরা হত্যা করে। সাহেরা কর্তৃক আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনাটি রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তিনি কী বলেছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। বরং তাকে ম্যানেজড সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে রায়ে।

সাক্ষী সাহেরা ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দীতে যা বলেছিলেন, তা এখানে তুলে ধরা হলো।

আমার নাম মোছা: সাহেরা। স্বামী মৃত ফজর আলী। আমার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। বাসা ১১ নম্বর তালতলা বস্তি, থানা পল্লবী। আমার স্বামী ফজর আলীরা পাঁচ ভাই ছিলেন। বড় ভাসুরের নাম সেকেন্দার, মেজো ফজর আলী (আমার স্বামী), মন্টু, টুনটুনি ও আব্বাস। আমার শ্বশুরের নাম মৃত মানিক সরকার, শাশুড়ির নাম গোলেহার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা সাভারে ছিলাম। সাভারে যাওয়ার আগে মিরপুর ১২ নম্বরে থাকতাম। ওই বাসায় আমার শাশুড়ি, ভাসুর, দেবর, আমি, আমার স্বামীসহ সবাই একত্রে বাস করতাম। ১২ নম্বর মুসলিমবাজার ছিল আমাদের বাসার ঠিকানা। টুনটুনির নামই পল্লব। পল্লব তখন মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বড় ছেলে ফারুক পাঁচ মাস বয়সের ছিল। আমার ও আমার স্বামীর ভোটার আইডি কার্ড আমার কাছে আছে। পল্লবকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আক্তার গুণ্ডা আর বিহারিরা হত্যা করেছে। যুদ্ধের পর সাভার থেকে আমরা আবার মিরপুরে ফিরে আসি। মুসলিমবাজারের ঈদগা মাঠে টুনটুনি ওরফে পল্লবকে আক্তার গুণ্ডা ও বিহারিরা হত্যা করে। আমি শুনেছি আমার দেবর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারত যাচ্ছিল, তখন নবাবপুর থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং মুসলিমবাজারে তাকে হত্যা করে। আমি জনগণের কাছ থেকে শুনেছি পল্লবের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ইতিপূর্বে এ মামলার ঘটনার ব্যাপারে আমি কারো কাছে কোনো জবানবন্দী দেয়নি।
       

No comments

Powered by Blogger.