শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন মাত্রা by ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ

দেশ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন যাঁরা, দেশের উন্নয়ন বা অগ্রসরতা মোটেই দেখতে পান না, টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি খবর কিছুটা হলেও তাঁদের মনে আশার সঞ্চার করবে এবং ভুল ধারণা পাল্টে দেবে। খবরটি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের।
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মানব উন্নয়নের প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। যাঁরা বাংলাদেশকে নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখছেন এবং বলছেন, তাঁদের জন্য অমর্ত্য সেনের বক্তব্যটি সময়োচিত এবং যথার্থ বলে মনে করি।
খবরটিতে বলা হয়, বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বোম্বে ক্যাম্পাসে জিএল মেহতা মেমোরিয়াল বক্তৃতায় বলেন, মানব উন্নয়নে লৈঙ্গিক (জেন্ডার) সমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
'খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, মানব উন্নয়নের সব সূচকেই ভারতের চেয়ে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। দেশটিতে গড় আয়ু বেশি, মৃত্যুহার কম এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেশি।' এমনকি অমর্ত্য সেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মানব উন্নয়ন, বিশেষ করে লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টি নিয়ে যেভাবে কাজ করা হচ্ছে, তারও কড়া সমালোচনা করেন। বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদের এই বক্তব্য থেকেই অনুমেয় যে বাংলাদেশ এখন কোন অবস্থানে রয়েছে। অমর্ত্য সেন তাঁর বক্তব্যে একটি কথা বলেছেন যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। অমর্ত্য সেনের এই বক্তব্যে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমার অত্যন্ত গর্ব হয়। কারণ আমি এই বাংলাদেশেরই মানুষ। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট, সে দেশের শিক্ষায় কেন জোয়ার জাগবে না। নতুন বছর এলো। বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিপ্লবাত্মক ঘোষণা দেন তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের সমাবেশে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি আওতায় এলো। ১৯৯১ সাল থেকে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করে এলেও এর আগে কোনো সরকারই তা মানেনি। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও অবহেলিত শিক্ষকসমাজের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োচিত ও প্রশংসনীয়। আমরা সবাই জানি, প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষকরাই তৃণমূল পর্যায়ের অগণিত শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে জীবন গড়ার ভিত্তি তৈরি করে দেন। জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুদের জীবনের ভিত্তিস্তর নির্মাণের মহান কারিগর প্রাথমিক শিক্ষকদের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকদের জীবন-জীবিকার কথা স্বাধীনতাপূর্বকালে তেমনটা ভাবা হয়নি। সে সময় এসব স্কুলের শিক্ষকরা সরকার থেকে সামান্য বেতন পেতেন। এই বেতন এতটাই সামান্য ছিল যে মানুষ গড়ার কারিগররা সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সদাই উপহাসের পাত্র হতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষকদের প্রতি জাতির জনকের আলাদা দৃষ্টি পড়ল। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন নতুন সম্ভাবনার সূচনা হলো, তেমনি অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকদের ভাগ্যও রাতারাতি পাল্টে গেল। প্রথমবারের মতো তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ গড়ার কারিগরদের অবদানের উপযুক্ত মূল্যায়ন করলেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের হাজারো সমস্যার মধ্যে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নকল্পে শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ১৯৭৩ সালে।
জাতির জনকের সেই ঐতিহাসিক ও সাহসী পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ৯ জানুয়ারি এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের কল্যাণে। শিক্ষক মহাসমাবেশে তিনি দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল এবং সেসব স্কুলের এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণের ঘোষণা দেন। ২২ হাজার ৯৮১টি স্কুল ও ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই ঘোষণা কার্যকর হয়েছে এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে। অন্যদের ক্ষেত্রে দুটি পর্যায়ে আগামী ১ জুলাই ও আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী ও সময়োচিত পদক্ষেপ প্রাথমিক শিক্ষাকে কতখানি এগিয়ে নিয়ে গেছে তা আমরা হয়তো এখন ভাবতেও পারছি না।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের মহাসমাবেশে শিক্ষার উন্নয়নে আজীবন কাজ করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষাকে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। শিক্ষার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মতো সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে ইতিমধ্যেই এর বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আপনারা চেয়েছিলেন শুধু রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ। আমরা যে শুধু এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করছি, তা নয়। আমরা স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও-বহির্ভূত কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এনজিও বিদ্যালয়, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত বিদ্যালয় এবং স্থাপিত কিন্তু চালুর অনুমতির অপেক্ষাধীন বিদ্যালয়গুলোও সরকারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।'
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের ৯ হাজার ২৫ জন শিক্ষককে ১ জুলাই থেকে এবং পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষককে তৃতীয় ধাপে আগামী বছর ১ জুলাই জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ঘোষণার মাধ্যমে অবহেলিত ও বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। প্রায় ২১ বছর ধরে এ দাবিতে আন্দোলন করার পর তাঁদের দাবি পূরণ হলো। মহাসমাবেশে আসা শিক্ষকদের চোখে-মুখে যে খুশি-আনন্দ আর বিজয়োল্লাস দেখা গেছে তা অভূতপূর্ব।
গ্রাম-গ্রামান্তরের লক্ষাধিক বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক মহানন্দে সমবেত হয়েছিলেন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেই মহাসমাবেশে তাঁদের চাকরি সরকারীকরণের ঘোষণা আসে বঙ্গবন্ধুকন্যার মুখ থেকে, যা সম্ভবত তাঁদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। যে প্রধানমন্ত্রী এতটা আন্তরিক, সে দেশের শিক্ষা কখনোই কি পিছিয়ে থাকতে পারে? আর যে দেশের শিক্ষা অগ্রসর, সে দেশের সব সূচকই এগিয়ে থাকবে- এটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে যথার্থ বক্তব্যের জন্য আমার গভীর শ্রদ্ধা।
পরিশেষে বলব, আজ এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয়েছে। তাঁরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাবেন। সমাজেও তাঁরা সম্মান পাবেন। এখন তাঁদের দায়িত্ব হবে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করা। সেই লক্ষ্যে তাঁরা নিবেদিত হয়ে কাজ করলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার হার যেমন বাড়বে, তেমনি তার গুণগত উৎকর্ষও বৃদ্ধি পাবে। এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.