আমার মনে বসন্তের নীল ঘণ্টা ধ্বনি by মাসুদা ভাট্টি

বসন্ত প্রেমের কথা বলে, আনন্দের কথা বলে। মনের ভেতর আচানক বাঁশি বেজে ওঠে। মাঘের শেষ বলে ীণধারার উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে একটু একটু দমকা দখিনা শরীরে এসে লাগে, আর তখনই মনটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে।
মনে হয়, পুরনো কোন প্রেমের কথা, ভালবাসার কথা, নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা ভেতর থেকে চাগাড় দিয়ে ওঠে। জীবনকে সুন্দর মনে হয় খুব। যদিও জীবনটা ভর্তি নানা খানা-খন্দে, চড়াই-উতরাইয়ে।
পৃথিবীর সর্বত্রই বসন্তকাল পালিত হয় নানা উদ্যমে, উদ্যোগে। শীতপ্রধান দেশে মূলত মার্চের ১ তারিখ থেকে বসন্তকালের শুরু। বরফ গলে গিয়ে সবুজ তৃণ কঠিন মাটি ভেদ করে রাতারাতি ঋজু হয়ে ওঠে, দামী স্যাফরন ফুলের কুঁড়ি সরাসরি বরফ ফুঁড়ে বেগুনি আর সাদায় মিলিয়ে তির তির করে দাঁড়ায়_ ওদের দেখলে মনে হয়, এতদিন এই শীতল বরফের নিচে ওরা কেমন করে ছিল? নিজেকে ওদের কাতারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ভাবলে, কান্না পায় খুব। কিন্তু ওরা ঠিকই গলাগলি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ঘাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। স্যাফরন-চাষীরা অপোয় থাকে কখন এই ফুল শুকাবে আর তাকে চিরে চিরে বের করে আনবে লম্বা শীষ, যা জলে ভেজালেই জাফরানি রং ধরবে খাবারে, সঙ্গে বেশ মাদকতা মাখা এক অপূর্ব গন্ধ।
আর ইউরোপে বিশেষ করে ব্রিটেনে এই সময়টা হচ্ছে ড্যাফোডিলের সময়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের টু-ড্যাফোডিল পড়ার সময় শেখানো হয়েছিল ড্যাফোডিল দেখতে ডালিয়া ফুলের মতো, মেনেও নিয়েছিলাম সে কথা। কিন্তু বহুকাল পরে যখন ড্যাফোডিলের সঙ্গে চাুষ জানাশোনা হলো, তখন ড্যাফোডিল আর ডালিয়ায় কোন মিল পাইনি, তবে এই মিল না পাওয়ায় খারাপ লাগেনি, অকাতরে ভালবেসে ফেলেছি ড্যাফোডিলকে। চমৎকার দর্শন এই ফুল বসন্তের প্রতীক। মজার ব্যাপার হলো, যদি কেউ কাউকে অ-ফোটা ড্যাফোডিল দেয় তাহলে ভাবতে হবে যে, ফুল আদান-প্রদানকারীদের মধ্যে ভালবাসা হবে হবে করছে। আর ফুটন্ত ড্যাফোডিল ভালবাসার তুঙ্গে পৌঁছানোদের নির্দেশ করে। ওহ্ ব্রিটেনের বিস্তীর্ণ বুনো এলাকায় এই ফুল থরে থরে ফুটে থাকে, আর তার পাশেই ফুটে থাকে নার্সিসাস নামে প্রায় একই রকম দেখতে তবে আকারে একটু ছোট এই ফুল। নার্সিসাসের শাব্দিক অর্থের মতোই আত্ম-অহং-এ টইটম্বুর এই ফুল, গ্রীবা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ড্যাফোডিলের পাশে। মজার ব্যাপার হলো, ওয়েলসে ড্যাফোডিল কিংবা নার্সিসাস কাউকেই তেমন একটা পাত্তা দেয়া হয় না। সেখানে আবার ব্লু বেল-এর জয়-জয়কার। এই ব্লু বেল বা নীল ঘণ্টা ওয়েলসের জাতীয় ফুল, এও বসন্তের ফুল। রবীন্দ্রনাথ কি এ কারণেই লিখেছিলেন, বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা, বইলো প্রাণে দণি হাওয়া, আগুন জ্বালা, বসন্তে ফুল গাঁথলো...। বাজারে যেদিন থেকেই ড্যাফোডিল পাওয়া যায় সেদিন থেকেই আমার প্রিয় মানুষটি আমার জন্য কিনে আনে গোছা গোছা ড্যাফোডিল, নার্সিসাস নয়, তবে আমার বাড়ির ছোট্ট বাগানে যে ক'টি ব্লু-বেল হয়, তা যেন আমার সমস্ত বাড়িতে রাতদিন বাজায় নীল ঘণ্টা। বসন্ত আমাদের ঘিরে রাখে রবীন্দ্রনাথের জয়ের মালায়, আমরা প্রেমের আগুন জ্বালাই। নেদারল্যান্ডসের বিস্তীর্ণ টিউলিপ েেতর দৃশ্য এ সময়ই রং ধরতে শুরু করে। চরাচরব্যাপী এই যে রঙের হেরফের মানুষকে শিল্পী না বানিয়ে মুক্তি দিতে পারে কি? ভ্যান গনা বা রেমব্র্যান্ট-এর মতো শিল্পীদের তাই রঙের জন্য হাহাকার করতে হয়নি, তারা চোখ খুললেই দিক বিস্তৃত এই রঙের ভেতর ঠাঁই করে নিয়েছেন। আহ্ রুশ দেশের বরফ চিরে বেরুনো ল্যান্ডাশের কথা না বললে, বিদেশের বসন্তের কথা অফুরান থেকে যাবে। তুমি আমায় ল্যান্ডাশ দিলে যুবক, আমি তোমার হব, যদি না দাও তবে বুঝব তুমি এখনও ভালবাসায় তৈরি নও_ রুশ ভাষার পল্লীগীতিটি এ রকমই, আহ্ তার কি সুর। বনের ভেতর সদ্য গলে যাওয়া বরফের শেষে সামান্য তৃণ উঠি উঠি করছে, তখন রুশ নারীকুল তাদের বিখ্যাত কুশিকাঁটার কাজ করা পিরান পরে এই গান গাইছে, এই শৈল্পিক দৃশ্যের তুলনা হয় না। বনেরই পুরনো কাঠে তৈরি টেবিলের ওপর অনেক খাবার-দাবার, যিশুখ্রিস্টের রক্ত বলে পান করা হয় যে সুরা, তাই গ্লাসে ঢেলে উদাত্ত কণ্ঠের সেই গান আর অবশ্যই একগোছা ল্যান্ডাশ ফুল, অদ্ভুত সুন্দর তার সৌরভ। পরে জেনেছি এই ফুলটিই ইংল্যান্ডে গিয়ে হয়েছে, লিলি অব দ্য ভ্যালি। বিখ্যাত নৈসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে কিউ গার্ডেনে বেড়াতে গিয়ে বেরিয়ে আসার সময় তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন একটি লিলি অব দ্য ভ্যালির তৈরি সুগন্ধি। দ্বিজেন শর্মা আমাকে যেন এক গোছা ল্যান্ডাশ দিয়েছেন, আমি সেভাবেই সেই সুগন্ধি রেখে দিয়েছি।
বিদেশের কথা অনেক হলো, এবার দেশের কথা বলি। অনেক দিন পর এবার ফাল্গুনে দেশে। খুব ছোটবেলায় যখন ঋতু চেনার মতো অভিজ্ঞতা জন্মায়নি কিংবা ধীরে ধীরে প্রতিটি ঋতুকে আলাদা করে চেনার চেষ্টা করছি তখনকার কথা নিয়ে আমি বাংলা ব্লগে লিখছিলাম বালিকার ঋতুদর্শন। সেখান থেকে এই ফাল্গুনে বর্ণনা তুলে দিচ্ছি খানিকটা। একদিন আচানক খেজুর গাছের রসের হাঁড়িতে রস কমতে শুরু করে। এই মাঘেও প্রায় গলা হাড়ি রস দিত যে গাছটি সেই গাছটিই পহেলা ফাল্গুনে যেন অর্ধেক রসও দেবে না, সেই পণ করেছে। গাছ কাটেন যিনি, তিনি গাছি, সেই খালেক গাছি বলেন, মা জননী ফাল্গুনে আইছে, এ্যাহন রস কইমা যাবেনে। তয় কি জানো মা জননী, এ্যাহন রসতো লয় য্যানো চিনি, এক চুমুক খাইয়া দ্যাহেন মা জননী, ভুলবার পারবেন না। সত্যি সত্যিই, ফাল্গুনের শুরুতে খেজুর রসের মিষ্টত্ব যেন তেগুণা। খুব ভোরে বাড়ির সামনে নাড়ার পালার ওপর পড়তে বসে রসে ভিজিয়ে মুড়ি খাওয়া, আহা রোদ তখন খুব দ্রুত তেজ নিচ্ছে, তাই মাঘের মতো রস খেয়ে কুঁাপুনির ভয় নেই। মাঘ মাসে বেলা উঠতে উঠতে সেই দুপুর, আর ফাল্গুনে সকালেই দুপুরের তেজ বলতে গেলে। আর আমাদের লেখাপড়ার সম্পর্কও এই বেলার সঙ্গে। এ কারণে মাঘে একটু বেশিই পড়তে হতো, কিন্তু ফাল্গুনে সে বালাই নেই। বেলা হয়েছে কত? এখন কিসের পড়া? দ্রুত নাড়ার ওপর বিছানো খেজুর পাতার পাটি গুছিয়ে স্কুল থাকলে ঝপাস করে পুকুরে পড়া আর স্কুল না থাকলেও পাশের খালে মাছ ধরতে যাওয়া। মাঘের শীততো নেই, আর খালেও পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ভাবতে অবাক লাগে ওই কাদা গোলানো পানিতে তখন কী করে নামতাম? এখন আমি নিশ্চয়ই সেই পানিতে নামতে পারব না। আসলে মানুষ ফেলে আসে অনেক সততা, অনেক আদিমতা, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে শুধু অসততাই শিখে তা নয়, মানুষ ক্রমশ মেকি হয়, সরলতা হারিয়ে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।
মাছ ধরা শেষ হলো তো গায়ে-হাতে মণকে মণ কাদা মেখে বাড়ি ফিরে বটি নিয়ে বসা, ধরা মাছ কুটতে হবে তো! আর তখনই হিসেব কষা হয়ে যায়, কোন মাছ কি দিয়ে রান্না হবে। দু'টো-তিনটে খলসে, তিন-চারটে ছোট টাকি, পাঁচটা কি ছ'টা তিতপুঁটি_ এগুলো শিম দিয়ে রাঁধলেই হবে। আর শীতের শেষে চষা েেতর আইলে যে মালঞ্চ শাক উঠেছে সেখান থেকে শাক তুলে এনে কুঁচো চিংড়ি দিয়ে রান্না হবে। আর যে ক'টি চান্দা-চুচড়ো উঠেছে সেগুলো দিয়ে এখনও ঘরের কোনায় পুঁই মাচায় যে ক'টি পাতা অবশিষ্ট আছে তা দিয়েই চলবে। তবে হঁ্যা, পুঁইগোটা পেকে লাল হয়ে আছে, একটু রসুন পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে সেগুলো ভাজি করলে পুরো ভাতই হয়ে যাবে লাল টকটকে, যেন লাল শাক দিয়ে ভাত মেখেছি। দিনভর এই খেলা মেলা, আমাদের বাইর-বাড়ির ভিটেয় যে বিশাল শিমুল গাছ তার তলায়। রান্না-বাটি শেষ করে শরীরে শুকিয়ে যাওয়া কাদা ধুতে ধুতেই শিমুল গাছটির কুড়ুলে বাজের ডাক কানে আসে, সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎই দেখে ফেলি, শিমুল গাছটি ছেয়ে গেছে লাল ফুলে। মাইকের মতো ফুলগুলো, ভেতরে চিকন হলুদ ডাটা। ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। আহা, কালই মা বলবেন, বাড়ি থেকে বেরুবে না একদম, চারদিকে বসন্ত হচ্ছে। আমরা দিনের কারাগারে বন্দী হয়ে যাব ঝটপট। প্রতিদিন মধু ফকির আসবে কোন্ দূরদেশে কার বসন্ত হয়েছে সে খবর নিয়ে। তার ভাঙা গলায় কথা বলা, একটি ধুতি শরীরের নিম্নাঙ্গে শাড়ির মতো করে কুঁচি দিয়ে পরা, আর আরেকটি ধুতি শাড়ির অাঁচলের মতো উর্ধাঙ্গে, মদ্দা হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় কথা বলা, কোন্ সন্ধেকে আরও ভীত করে তুলত আমাদের জন্য। বালিকার মন তখন আনচান করত, কোথায় কোন্ দেশে চলে যেতে চাইত বালিকা নিজেও তার হদিস জানে না। বালিকা ক্রমশ প্রেম চিনতে শিখেছিল, শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। বহু বছর পর বালিকা তার কাছের মানুষকে এই ঋতুর বর্ণনা শুনিয়েছিল, আর তারপর সেই মানুষটি তাকে এই দিনেই পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমাঙ্গুরী। তাই পহেলা ফাল্পুন দিনটি বালিকার কাছে এখন একটি বিশেষ দিনও বটে।
আজ শহুরে কেতায় পয়লা ফাল্গুন উদ্যাপন আমায় আনন্দ দেয় ঠিকই, উল্লসিতও করে, কিন্তু আমার বালিকাবেলার ফাল্গুন আমাকে স্মৃতিমেদুর করে খুব। আজ ফাল্গুন মানেই ভালবাসা দিবস, বাসন্তি রঙা শাড়ি সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আনন্দ-বিভোর দিন বাঙালীর জন্য। একটি বিশেষ দিনকে চিহ্নিত করে এভাবে আনন্দময় করে তোলার এই কায়দাটি নতুন এবং আধুনিক। আমরা ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠছি তা প্রমাণ করে এই ভালবাসা দিবস কিংবা পিতা-মাতা-ভ্রাতা দিবসগুলো। আমি এতে খারাপ কিছুই দেখি না, বরং মানুষের ব্যস্ত জীবনে খানিকটা নিশ্বাস ফেলার ফুরসত এনে দেয় এই দিবসগুলো। তবে ভয় লাগে এটা ভেবে যে, আজকে ধর্মব্যবসায়ীরা না আবার এই দিনকে বেদ্-আতি ঘোষণা করে উদ্যাপনকারীদের আক্রমণ করে বসে? এই ভয় যে ফেলনা নয় তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি উদীচী কিংবা রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে। ভেবেছিলাম আজ দেশব্যাপী শিবিরের তাণ্ডব নিয়ে লিখব, কিন্তু সম্পাদক জানালেন, আপনার লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে সেদিন পহেলা ফাল্গুন তাই লেখাটি পহেলা ফাল্গুন নিয়ে লিখলেই ভাল হয়। আমার এই কলামটি পরিচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখার জন্য। আজকে দেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তা আসলে খুব ভাল ইঙ্গিত দেয় না। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ধর্ম রার নামে মাঠে নামছে তা আসলে সামনের দিনগুলোর বিভীষিকাকে উগ্র করে তোলে। অথচ যে ধর্ম নিয়ে তারা গেল গেল রব তুলছে তা কোথায় কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তা কেউ মুখ ফুটে বলে না। দুঃখটা আসলে সেখানেই। চিলে কান নিয়ে গেল বলে চিলের পেছনে ধর্ম ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে ছোটানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কান যে সঠিক স্থানেই আছে, মানে বাঙালীর ব্যক্তিজীবনে ধর্ম যেখানে থাকার কথা ঠিক সেখানেই যে আছে এ কথাটি সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে নইলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিজীবীদের খপ্পরে পড়ে অচিরেই বাঙালি সর্বস্ব হারাবে_ এর চেয়ে বড় কোন সত্য নেই। আজ ফাল্গুনের এই আনন্দ দিনে এই নিরাশার কথাটা না শুনিয়েই পারলাম না, সে জন্য মাপ্রার্থী।
সবকিছুর পরেও, আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তাই আনন্দম আনন্দম আনন্দম।
ঢাকা, ৩১ শে মাঘ, শুক্রবার।
বট্রলঢটঠদর্টর্ধআদর্মবটধফ.ডমব

No comments

Powered by Blogger.