প্রসঙ্গ ইসলাম- পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর তাপর্য by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

আল্লাহ জাল্লা শানুহুর প্রথম সৃষ্টি নূরে মুহম্মদীর মানব সুরতে যেদিন পৃথিবীতে তশরীফ আনেন সেদিনই পবিত্র ঈদ-ই- মিলাদুন্নবীর দিন, সেদিনই প্রিয় নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্মদিনের আনন্দ উৎসবের দিন, সেদিন বিশ্বমানব সভ্যতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম আনন্দের দিন।
হযরত জাবির ইবনে আবদুলস্নাহ রাদি আল্লাহু তা'আলা আনহুর বরাত দিয়ে আবদুর রাজ্জাক একখানা দীর্ঘ হাদিস সনদসহ বর্ণনা করেছেন। সেই হাদিসখানির উদ্ধৃতি বহু নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে রয়েছে। সে হাদিসখানি সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার জন্য অতি গুরম্নত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ। সেই বিখ্যাত হাদিসখানি এইরূপ : হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আমি একদিন আরয করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমার আব্বা-আম্মা কুরবান হোক অপনার জন্য। আপনি আমাকে এ তথ্যটা জানান যে, আলস্নাহ্ তা'আলা কোন্ জিনিস সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেন? হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ্ তা'আলা তাবত্ কিছু সৃষ্টির পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেন। অতঃপর সেই নূর আলস্নাহর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর কুদরতে সজোরে ঘূর্ণায়মান থাকে। তখন লওহ ছিল না, কলম ছিল না, জান্নাত ছিল না, জাহান্নাম ছিল না, ফেরেশতা ছিল না, আসমান ছিল না, জমিন ছিল না, সূর্য ছিল না, মানুষ ছিল না- কিছুই ছিল না। অতঃপর আলস্নাহ তা'আলা সৃষ্টি করার ইরাদা করলেন। সেই নূরকে চার ভাগে বিভক্ত করলেন। প্রথম ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন কলম, দ্বিতীয় ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন লওহ, তৃতীয়ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন 'আরশ।...
দীর্ঘ এই হাদিসখানির সম্পূর্ণটা পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেই নূর মুবারক অর্থাৎ নূরে মুহম্মদী-ই হচ্ছে আলস্নাহর প্রথম সৃষ্টি। একখানা হাদিসে কুদ্সী আছে যাতে এটা প্রস্ফুটিত হয়ে যায় যে, আলস্নাহ্ জালস্না শানুহু ছিলেন গুপ্তধন। তিনি আপন মহিমা ও গরিমায় মহিমান্বিত অবস্থায় ছিলেন। তিনি আপন কুদরতের মহিমা বিকশিত করার ল্যে তাঁর স্রষ্টা গুণের বহিপর্্রকাশ ঘটানোর ল্যে তিনি এক স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল নূরের উন্মেষ ঘটালেন। এই নূর অসত্মিত্বপ্রাপ্ত হবার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি জগতের সূচনা হলো। সেই নূর থেকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হলো নতুন নতুন মখলুক। অধুনা বিগ ব্যাং থিউরি যতবেশি আলোচিত হবে এবং একে নিয়ে যত বেশি গবেষণা করা হবে তত নূরে মুহম্মদী সম্পর্কে জানা যাবে, নূরে মুহম্মদী-ই যে সৃষ্টির আদি উৎস তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নূরে মুহম্মদী সৃষ্টির মাধ্যমে আলস্নাহ জালস্না শানুহু সারা জাহান তথা সৃষ্টি জগতের যাবতীয় কিছু সৃষ্টির সূচনা করেন। সেই নূর মুবারকই আমাদের প্রিয় নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্সম খাতামুন্নাবীয়িন রহমাতুলিস্নল 'আলামীন হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহ 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের মুবারক নূর। এই নূর মুবারক সৃষ্টি করে বিশ্বজগত সৃষ্টির যেমন সূচনা করা হয় তেমনি নবুওয়ত ও রিসালতও সূচিত হয়। তখনই হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামকে নবুওয়ত ও রিসালতের অভিষেকে অভিষিক্ত করা হয়। তিনি বলেছেন : আমি রসূলগণের ভূমিকা এবং নবীগণের উপসংহার।
সূরা আল ইমবানের ৮১ নম্বর আয়াতে কারীমায় নবীদের মিছাক বা অঙ্গীকারের উলেস্নখ আছে। আলস্নাহ্ জালস্না শানুহু নবীদের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমাদের কিতাব ও হিকমতের সমর্থকরূপে একজন রসূল আসবেন, তোমরা তাঁর প্রতি অবশ্যই ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আলস্নাহ্) বললেন : তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল : আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন : তাহলে তোমরা সাী থাকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাী থাকলাম।
সূরা আল ইমরানের ৮১ নম্বর আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা করতে যেয়ে হযরত আলী করমালস্নাহু ওয়াজহাহু এবং হযরত আবদুলস্নাহ ইব্নে 'আব্বাস রাদিআলস্নাহু তা'আলা আনহু বলেছেন : আলস্নাহ্ সব নবীর কাছ থেকে হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নাম সম্পর্কে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁরা যদি তাঁর আমল পান তাহলে তাঁর ওপর ইমান এনে তাঁকে সাহায্য করবেন আর যদি না পান তাহলে পরবতর্ীদের কাছে এ খবর দেবার জন্য অনুসারীগণকে বলে যাবেন।
তাই দেখা যায় পৃথিবীতে যত নবী-রসূল এসেছেন তাঁরা সবাই হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের পৃথিবীতে আবিভর্ূত হবার আগাম খবর দিয়ে গেছেন। অনেক নবী-রসূল তো শেষ নবীর উম্মত হবার ইচ্ছা পোষণ করতেন, এমনকি হযরত ঈসা 'আলায়হিস সালামের উম্মতে মুহম্মদী হবার ইচ্ছে পূরণ হবে কিয়ামতের পূর্বে কিয়ামতের আলামত হিসেবে পৃথিবীতে অবতরণের মাধ্যমে।
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম তাঁর সদ্যোজাত পুত্র সনত্মানসহ বিবি হাজেরা 'আলায়হাস সালামকে মক্কার বিরান উপত্যকায় আলস্নাহর নির্দেশে রেখে আসেন তখন তাঁকে জানানো হয় এখানে তাঁর সনত্মানদের মধ্য হতে উম্মী নবী ও খাতামুন্নাবীয়িন আসবেন। হযরত ইয়াকুব আলায়হিস সালামের নিকট নাযিলকৃত এক ওহীতে বলা হয় যে, এমন এক নবী প্রেরণ করা হবে যাঁর নাম হবে আহ্মদ এবং যিনি হবেন খাতামুন্নাবীয়িন_নবীগণের শেষ।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মা কানা মুহম্মাদুন আবা আহাদিম্ মির্ রিজালিকুম্ ওয়ালাকির্ রসূলালস্নাহি ওয়া খাতামান ্ নাবীয়িন্_ মুহম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরম্নষের পিতা নন, বরং তিনি আলস্নাহ্র রসূল এবং শেষ নবী। (সূরা আহ্যাব : আয়াত ৪০)।
তওরাত কিতাবে প্রিয় নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের 'আহ্মদ' নাম মুবারক দৃষ্ট হয় 'হিম্দা' উচ্চারণে। জেরম্নজালেমে সোলায়মানের ইবাদতগাহ্ আগুন লেগে পুড়ে গেলে এবং ইয়াহুদীদের দীর্ঘকাল বন্দিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে দিন গুজরানকালে তাদেরকে একজন মহানবীর আগমনের আগাম খবরের উলেস্নখ আছে এইভাবে : ও রিষষ ংযধশব ধষষ হধঃরড়হং, ধহফ ঃযব ঐরসফধ ড়ভ ধষষ হধঃরড়হং রিষষ পড়সব ধহফ ও রিষষ ভরষষ ঃযরং যড়ঁংব রিঃয াবৎু, ংধুং ঃযব খড়ৎফ ড়ভ যড়ংঃং- মহাপ্রভু বলেন : আমি প্রকম্পিত করে দেব সব জাতিকে অতঃপর সব জাতির হিমদা আসবে এবং আমি পূর্ণ করব এই গৃহকে গৌরব দ্বারা (ঐধমমধর, ১১, ৭-৯)। এখানে উলেস্নখ্য যে, হিব্রম্ন হিমদা এবং আরবী আহমদ শব্দের বু্যৎপত্তিগত অর্থ একই।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে প্রিয়নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের পৃথিবীতে আগমনের আগাম খবর এবং তাঁর নবুওয়তের ও রিসালতের যে সব তথ্য রয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে নবুওয়তে ও রিসালতে মুহম্মদীর সার্বজনীনতা স্পষ্ট হয়ে যায়।
সেই মহানবী নবীদের নবী রসূলগণের রসূল যেদিন যে ণে পৃথিবীতে তশরীফ আনলেন, যেদিন যেণে তিনি নূরের অবয়ব নিয়ে মানব সুরতে পৃথিবীতে তশরীফ আনলেন সেদিন আসমান-জমিনের সর্বত্র আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হয়েছিল।
প্রিয় নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়াসালস্নাম যখন ভূমিষ্ঠ হচ্ছিলেন তখন প্রসূতির দায়িত্ব পালন করছিলেন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিআলস্নাহু তা'আলা আনহুর মাতা হযরত আশ্শিফা। আশ্শিফা বলেছেন : সদ্যোজাত রসূল (সা) আমার হাতে এলে তাঁর উজ্জ্বল চেহারার ঔজ্জ্বল্যে সারাঘর আলোময় হয়ে গেল। আমেনার কুটিরের ভেতরে বাইরে কারা যেন কি উচ্চারণ করছিল। আমার সামনে পূর্ব ও পশ্চিম আলোকিত হয়ে গেল। আমার সামনে যেন রোমের রাজপ্রাসাদ উদ্ভাসিত হয়ে গেল। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আছিয়া ও মরিয়াম এবং হুরগণ সেই ণে সেই কুটিরে রূহানী হালতে উপস্থিত ছিলেন। হাজার হাজার রহমতের ফেরেশতা আমেনার কুটির ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম মধুর ইলহানে উচ্চারণ করছিলেন। যে কারণে আজও সেই ণটি স্মরণ করে মিলাদ মাহফিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিয়াম করে ইয়া নবী সালামু আলায়কা/ইয়া রসূল সালামু 'আলায়কা/ইয়া হাবীব সালামু আলায়কা/সালাওয়া তুলস্নাহি 'আলায়কা পড়া হয়।

লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)

No comments

Powered by Blogger.