ঐতিহাসিক রায়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি? by আয়েশা নুসরাত জাহান

যুদ্ধাপরাধ' শব্দটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক দগদগে ঘা। একাত্তরে যারা পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছিল নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগি্নসংযোগ করে দেশটাকে ছারখার করে দিতে, তারা যেন তাদের কৃতকর্মের জন্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে শাস্তি পায়, তার জন্য দেশের প্রতিটি মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল।
এই অপেক্ষার অবসান ঘটে গত ২১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ১১২ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণার মাধ্যমে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট এই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটটি অভিযোগের সাতটি প্রমাণের ভিত্তিতে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গত বছর ২ সেপ্টেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে, যাতে লুট, ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যা ও অগি্নসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আযাদ তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ মার্চের কালরাতের পর তিনি সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম এই রায়ে পুরো জাতির ঝিমিয়ে পড়া স্বপ্ন যেন আবার জেগে উঠল। অনেক সংগঠন এই রায়ে আনন্দ মিছিল বের করেছে। কিন্তু জাতির এই আনন্দে বাদ সাধে আসামির পলাতক থাকার খবরটি। জনমনে প্রশ্ন_ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগগুলো সতর্ক থাকার পরও কীভাবে আবুল কালাম আযাদ পালানোর সুযোগ পেলেন? এই রায়ে দেশবাসী খুশি। কিন্তু সরকারি তৎপরতা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়। আমরা জানি না_ পলাতক আসামিকে ধরতে পারা এবং যারা গ্রেফতার অবস্থায় আছে তাদের রায় হতে আমাদের আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? ২০০৯ সালে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে রায় হলো তা যেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের আনন্দকে পূর্ণতা দান করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হিসেবে আবুল কালাম আযাদের ফাঁসি জাতির জন্য সুসংবাদ। কিন্তু শুধু রায় দিলেই যথেষ্ট হবে না; এ রায় কার্যকর করার মাধ্যমে সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রকাশ করা এবং রাজাকারদের ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত করাও একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাঙালি জাতির কাছে কলঙ্কিত নাম। জাতির প্রত্যাশা সেদিন পূরণ হবে, যেদিন বাংলার মাটিতে আর কোনো রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধীর চিহ্ন থাকবে না।
জাতির প্রত্যাশার মূলকথা হলো, এ বিচারের রায় যেন কার্যকর হয়। শুধু রায় হলেই সব প্রত্যাশা পূরণ হয়ে যায় না। সবে দুঃস্বপ্নের আঁধার কাটল। এর পথ ধরে সত্যিকারের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
আয়েশা নুসরাত জাহান :শিক্ষার্থী
লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.