স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে by সাইদ আল হক

১৯৭১ থেকে ২০১৩। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে হিসাবনিকাশ মোটেও কম নয়। সাফল্য ও ব্যর্থতার অঙ্ক কষা হয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। কিন্তু হিসাবের ফলাফল সবসময় রেখচিত্রের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর যখন আজ এই দূরত্ব আরও বাড়তে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে ঐতিহাসিক এই রায় চলমান দূরত্বকে কমিয়ে সব ধ্যান-ধারণার মানুষকে একই প্লাটফর্মে আসতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে_ নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী সব মানুষের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাচ্চু রাজাকার নামে কুখ্যাত মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনীত ৮টি অভিযোগের মধ্যে ৭টি প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন। এর মধ্যে ৩, ৪, ৬ নম্বর অভিযোগ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন অপরাধ হলেও ৭ নম্বরটি ছিল গণহত্যার অভিযোগ। ২ নম্বর অভিযোগ থেকে যদিও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তবু বাকিগুলোর কাছে এটা অর্থহীন। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় অনেক হতাশার মাঝেও আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে। মৃত্যুদণ্ডের মতো আদেশেও যখন মানুষ আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে, মিষ্টি বিতরণ করে, তখন তাদের বেদনার ক্ষতগুলো যে কত তীব্র, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই রায়ে দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোরও উৎসাহের কমতি ছিল না। বিবিসি, এএফপিসহ বড় ধরনের গণমাধ্যমগুলো তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইতিমধ্যে এই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ইকোনমিস্ট, ফরেন অ্যাফেয়ার্সসহ স্বনামধন্য কিছু গণমাধ্যম ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। মাত্র কিছুদিন আগে স্কাইপি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপিতে কথোপকথন নিয়ে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তুলকালাম সৃষ্টি করেছিল যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা। তার ফলে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করলে তার রেশ ধরে ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার জন্য হইচই শুরু করে দিয়েছিল দলটি। তার সঙ্গে যখন তুরস্কের মতো প্রভাবশালী দেশের প্রত্যক্ষ এবং মিসর, তিউনিসিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ এ বিচারকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছিল; ঠিক তখনই এই ঐতিহাসিক রায় নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য বড় ধরনের সাহসিকতার পরিচয় এবং আমাদের জন্যও বড় অর্জন। তবে এই অর্জনকে চলমান রাখা মোটেও সহজ হবে না নিশ্চয়ই।
বাচ্চু রাজাকার জামায়াতের বহিষ্কৃৃত নেতা হওয়ায় তার ফাঁসির রায়ে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও তাদের বর্তমান নেতাদের রায়ের পর তারা যে নিশ্চুপ থাকবে না_ তা বোঝা যায় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পূর্বমুহূর্তে জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী নাশকতা দেখে। যদিও পরবর্তী সময়ে স্কাইপি বিতর্কের কারণে মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় পিছিয়ে যায়। সরকারকে জামায়াত-শিবিরের এই তৎপরতা অবশ্যই আমলে নিতে হবে। কারণ, তারা যে কোনো সময় একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং এ সফলতাকে গতিশীল রাখতে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। রাষ্ট্রীয় হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনটির লাগাম টেনে ধরতে হবে। খুন, ধর্ষণ, শিক্ষকদের ওপর এসিড নিক্ষেপসহ তাদের অপকর্ম সরকারের এ সফলতাকে মাটি করে দিতে পারে। কারণ এই ছাত্র সংগঠনটির কারণে ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক সফলতাকে খাটো করে দেখা হয়েছে। সুতরাং সরকারকে এসব সমস্যার সমাধান করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দেশের সব মানুষকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই আমরা সব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের রায় কার্যকর করতে সক্ষম হবো। সেই দিনটির প্রহর গুনছে এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সব মানুষ।
সাইদ আল হক :শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.