চরাচর-ডুমুরিয়ার গণহত্যা by গৌরাঙ্গ নন্দী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্বের একটি বড় ঘটনা গণহত্যা। সেই সময়ের দখলদার পাকিস্তানি রাজনৈতিক দর্শনের একটি বিশেষ দিক ছিল মুক্তিকামী বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে সাম্প্রদায়িক মোড়কে আচ্ছাদিত করার জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দুদের বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করা হয় শুরু থেকে।
মুক্তিযুদ্ধকে হানাদার পাকিস্তানিরা ভারত তথা হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত ও উপস্থাপনের চেষ্টা করে। যে কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বারবার আক্রান্ত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে, তাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। নির্মূলকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করা হয়। এরপর সেই আক্রমণ আজকের বাংলাদেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। খুলনা অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাস বেশি হওয়ায় এখানে বহু গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হচ্ছে ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের গণহত্যা। দিনটি ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বৈশাখ বরণে সেদিন রংপুর গ্রামের মানুষ উচ্ছ্বসিত ছিল। যুদ্ধের আবহ শুরু হলেও বিশেষ এই দিনটির জন্য মানুষের মনে ছিল আনন্দের হিল্লোল। ওই দিনই হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি বহর প্রবেশ করে সেখানে। পথ দেখানোর কাজ করে তাদের এদেশীয় দোসররা। সেদিন রংপুর, শলুয়া, ঘোনা, রামকৃষ্ণপুর, বটবেড়া, কৃষ্ণনগর, লতা প্রভৃতি গ্রামে শতাধিক বাঙালিকে হানাদাররা হত্যা করে। যত দূর জানা যায়, এখানকার গণহত্যার প্রথম শিকার হন ভোম্বল মণ্ডল নামের সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। রংপুর কালীবাটি এলাকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ইন্দুভূষণ বিশ্বাস, লালচাঁদ বিশ্বাস এবং সবার প্রিয় অভিভাবকতুল্য প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস। স্বনামখ্যাত প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৩৫ সালে বর্তমানের বি এল কলেজ থেকে আইএ, ১৯৩৭ সালে বিএ পাস করে ১৯৪৬ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন। শহরে চাকরি করার সুযোগ পেয়েও তা না গ্রহণ করে চলে আসেন গ্রামে। শুরু করেন শিক্ষকতা। তিনি একাধারে ১০ বছর রংপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। সবাই তাঁকে গুরু বলত। এই বৃদ্ধকেও তাঁর বাড়ি থেকে ধরে পাশের বিলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এই গ্রামের রতন বিশ্বাস ও নীহার বিশ্বাসকেও শলুয়া বাজার থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আরো হত্যার শিকার হন অমূল্য মণ্ডল, নির্মল ঢালী, অমূল্য জোদ্দার, মথুর ঢালী, মহেন্দ্রনাথ ঢালী প্রমুখ। রংপুর গ্রামের মানুষ আজও বাংলা নববর্ষের আনন্দে মেতে উঠতে পারেন না। তাঁরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন গণহত্যার শিকার তাঁদের প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্ল বিশ্বাস ও অন্য সব স্বজনকে।
গৌরাঙ্গ নন্দী

No comments

Powered by Blogger.