প্রকৃতির মায়ায় ঘেরা মৌলভীবাজার by মোঃ জাবেদ হাকিম

‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা যাব বাইক্কা বিল। ঘটনা চক্রে যাওয়া হলো জাঙ্গালিয়া। কি করে যে কি হলো এই প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং কি কি দেখা হলো এবং কত কিছু জানা হলো সেই কথায় যাই।
খুব ভোরে গিয়ে নামলাম সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলাধীন উত্তর বাজার। আগে থেকেই সুলভ থান বিতানের স্বত্বাধিকারী মারুফ বোডিং ও গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। যার ফলে ঠিকঠাকের ঝামেলা এড়িয়ে সোজা রুমে। কনকনে শীতের মধ্যে ঠা-া পানিতে ফ্রেশ হয়ে জামাতের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করে সঙ্গে থাকা চিড়া, মুড়ি, মিঠাই নিয়ে প্রথমেই হাকালুকি হাওড়ের দিকে গাড়ি টার্ন করালাম। ড্রাইভার চেংড়া বয়সের আবদুল জলিল। গাড়ি দেখে খুব একটা পছন্দ না হলেও তার অভিবাদন, গাড়ি চালানোর স্টাইল দারুণ ভাল লেগে গেল। সন্তুষ্ট হয়ে পুরো ভ্রমণকাল ওর গাড়ি নিয়েই ঘুরেছি। স্বদেশের অপরূপ সৌন্দর্য যা কিছু দেখলাম, তা প্রথমে হাকালুকি হাওড়ের বর্ণনা দিয়ে শুরু করছি।
হাকালুকি হাওড়
বাংলাদেশের বৃহৎ হাওড় হলো হাকালুকি। অনেকগুলো বিলের সমন্বয়ে সৃষ্ট এই হাওড়। প্রায় ৩২২ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের আবাস। সকালের কুয়াশা ভেদ করা সোনা রোদ গায়ে মেখে হিমহিম ঠা-া বাতাসে বিভিন্ন সবজি ক্ষেতের আইল ধরে যখন যাচ্ছি, তখন দেহ-মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। সারা রাতের বাস জার্নির ঝক্কি নিমেষেই মিলিয়ে গেল। হাকালুকি হাওড়ে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য অতিথি পাখি দেখা। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পরও যখন দেশী বক, পানকৌড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, এমনকি আমরা কয়েকজন ছাড়া চারপাশে আর কোন জনমানবও নেই, তখন ধরে নিলাম ভুল পথে এগোচ্ছি। হঠাৎ ছিপছিপে শরীরের একজন ছেলেকে দেখতে পেয়ে মনে আশার সঞ্চার হলো। নাম জিজ্ঞাসা করতেই বলল রুবেল। আমিও সাথে সাথে ওকে বাংলা ছবির মার্শাল আর্ট হিরো রুবেলের সাথে তুলনা করে বিভিন্ন কথা বলতে শুরু করলাম। লক্ষ্য ওর সাথে ভাব জমানো। ওকে মজাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। হাওড় পারের ছেলে সরল প্রকৃতির। আমাদেরকে নিয়ে গেল কালিঙ্গি বিলের কাছাকাছি। হাজার মাইল দূর থেকে আসা অজস্র পাখির মেলা। ওয়াও। এত্তো এত্তো (অনেক অনেক) পরিযায়ী পাখি, হরেক রকমের নানান রঙের পাখি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো কিংবা লিখে বোঝানোর মতো দক্ষতা আমার নেই। একমাত্র স্বচক্ষে দেখলেই অনুভব করা সম্ভব। আমাদের সাথে কোন পক্ষি বিশারদ না থাকায় দু’চারটি পাখির নাম জানা ছাড়া অধিকাংশ পাখির নামই অজানা থেকে গেল। জীবনে একসঙ্গে এই প্রথম এত পাখি দেখতে পেয়ে একপর্যায়ে কৌতূহলের বাঁধ ভেঙ্গে পাখিদের পিছু নিলাম। ওদেরকে উড়িয়ে দিয়ে আরও বাহারি রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। একপাশ থেকে ওড়াচ্ছি তো আরেক পাশে দল বেঁধে বসছে। যখন আকাশে ডানা মেলে উড়াল দেয় তখন মনে হচ্ছিল কোন রঙের মেলা প্রদর্শনী হচ্ছে। বিলের পানি পাখির গায়ের রঙে একাকার। সে অন্য রকম ভাল লাগা, মনলোভা আবেশ। ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিল সদ্য পরিচিত সিলেট থেকে আগত শৌখিন ফটোগ্রাফার কাজি সোহেল তানভির মাহমুদ। তাকে পেয়ে যারপরনাই খুশি হলাম। বিভিন্ন এঙ্গেলে পাখির ফটোসেশন হলো। এবার হাস্যোজ্জ্বল রুবেলের আবদারÑ চলুন আমাদের লিজ নেয়া বিলে। আমন্ত্রণ পেতে দেরি, গ্রহণ করতে ‘দে ছুট’ দল কখনও দেরি করে না। তাও যদি হয় আবার ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট। ছুটছি এবার মাছের সাথে সখ্য গড়তে। সত্যি সত্যি তাই হলো। উপস্থিত জেলেদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হতেই জিন্স ছেড়ে গামছা পরে পুরোদস্তুর জেলে হয়ে গেলাম। বিলের পানিতে টানা জালে মাছ ধরা এবং ঘাগর মাছ রেঁধে খাওয়াও হলো। হাকালুকি হাওড় ভ্রমণে টাটকা মাছের স্বাদ আর মোটা চালের ভাত আজীবন মনে থাকার মতো স্মৃতি হয়ে রইল। এবার বিদায়। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বয়ে নিয়ে এলাম কত কষ্ট করে হাড় কাঁপানো শীতে জেলেরা মৎস আহরণ করে, ধনী বাবুদের রসনা মেটানোর জন্য।
পূর্ব থেকেই সংবাদ ছিল কুলাউড়া গোবিন্দপুর সিআরপি রেস্ট হাউসে রাত্রে গেলে শিয়াল, খাটাশ, বাঘডাসা, গন্ধগোকুলের মতো প্রাণীর দেখা মিলে। সেই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে হাজির হলাম সেখানে। পথেই অভ্যর্থনা জানাল লাল রঙের শিয়াল প-িত। খেয়েদেয়ে ভালই নাদুশনুদুশ। মূল বাউন্ডারিতে প্রবেশ করে বর্তমান রেস্ট হাউস ইনচার্জ ফিজিওফেরাপিস্ট ফারুক আহমেদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষে বেশ খানিকটা সময় ভিতরে ঘুরে দেখলাম। টিলার ওপর চমৎকার সব বাংলো। ইউক্যালিপ্টাস গাছসহ বিভিন্ন বৃক্ষে আবৃত। অনুমতিক্রমে বাংলোতে রাতযাপন করলে কোন প্রাণীর দেখাও মিলতে পারে। সদালাপি ফারুক সাহেবের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আগামীতে রাত্রিযাপনের বাসনা মনে পুষে ফিরে এলাম আমাদের নির্ধারিত বোডিংয়ে।পরের দিন ছুটছি গাজীপুরের দিকে। রবিন, মোস্তাকের ক্লান্তিহীন অফুরন্ত চুটকি (কৌতুক), শাহাদাতের আধ্যাত্মিকতায় ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত। মজার ব্যাপার হলো মাঝে কয়েকটি ভ্রমণে মোস্তাকের শ্বশুর তাকে বিভিন্নভাবে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার আর কোন বাধাই ওকে দমাতে পারেনি। ‘দে ছুট’ বন্ধুদের টানে আবার ছুটে এসেছে আমাদের মাঝে। আফসোস হয়েছে শুধু জসিমের জন্য। সে তার বউয়ের পাল্লায় পড়ে প্রাকৃতিক নিদর্শন দেখা হতে বঞ্চিত।
গাড়ি থামল গাজীপুর। এই গাজীপুর কিন্তু ঢাকার পাশে জ্যামযুক্ত গাজীপুর জেলা নয়। এটি কুলাউড়া উপজেলার একটি প্রাকৃতিক নিসর্গ শোভাম-িত অঞ্চল। ইস্পাহানী চা বাগানের মূল ফটকে এসে অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে প্রবেশ করলাম পাহাড়ের ওপর তাদের নিজস্ব বাংলো। গাড়ি প্রবেশের অনুমতি না পাওয়ায় হেঁটে বাংলোর দিকে এগোচ্ছি। খুব সুন্দর পথ করে দেয়া। বামে উঁচু পাহাড়, ডানে গিরিখাদ, দু’পাশে বিশাল আকৃতির বৃক্ষ। ছায়াঘেরা পাহাড়ী বৃক্ষের পথ হাঁটতে ভালই লেগেছে। বাংলোতে পৌঁছে চোখ ছানাবড়া! দক্ষিণ দিকে তাকালে মনে হয় বান্দরবান চিম্বুক পাহাড়ে অবস্থান করছি। পানি পান শেষে মনস্থির করলাম, এবার সরাসরি শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল। তখনও জানতাম না আমাদের জন্য কেমন নয়নাভিরাম প্রকৃতি অপেক্ষা করছে। গাড়ির সামনে আসতেই চোখ পড়ল পশ্চিম দিকে। পাহাড়ের বুকে পিচ করা রাস্তা। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সামনে ফুলতলা বর্ডার। আর যায় কোথায়, চল সামনে কিছু দূর যাই। যতই সামনে যাচ্ছি ততই দু’পাশের নজরকাড়া প্রকৃতির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। ইতোমধ্যে বাইক্কা বিলের সিডিউল বাতিল করে ফুলতলার দিকে যাচ্ছি। এ্যাডভেঞ্চার পথের বর্ণনা নাইবা দিলাম। সরেজমিনে অনুভব করবেন।
ভ্রমণপিপাসু বন্ধুরা বিশ্বাস করুন আর না করুন। তাতে আমার কিচ্ছু আসে না। তবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিন। আমি দেশ বিদেশের অনেক চা-বাগান ঘুরেছি। কিন্তু এত সুন্দর প্রাকৃতিক শোভাবর্ধিত হৃদয়গ্রাহী চা-বাগান সম্ভবত এই প্রথম দেখেছি। বিমুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়ে রয়েছি। এত সুন্দর চা-বাগানও কি রয়েছে আমাদের দেশে? সত্যি বলতে কি স্বদেশপ্রীতির জন্য এমনটি হয়েছে কিনা জানি না, তবে দার্জিলিংয়ের চা-বাগান হতে কয়েক গুণ বেশি ভাল লেগেছে। পাহাড়, সমতল ঘেরা বিশাল বিশাল চা-বাগানের মাঝে শুধু আমরা ক’জন, উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভেসে হাই ভলিয়মের মিউজিকে কিছুক্ষণ নাচলাম আর গলা ছেড়ে গাইলাম। গাড়ি এসে থামল একটি বাজারে, ডানে চলে গেল বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত, বামে জাঙ্গালিয়া। দোকান হতে চা, বিস্কুট, চিপস খাওয়া হলো। জাঙ্গালিয়া নাম নিলেই গা ঝিমঝিম। এটি জুড়ী উপজেলায় অবস্থিত। দু’পাশে গভীর বন-জঙ্গল, মাঝে পিচ করা রাস্তা। পাহাড়ী ঝিরির জলে মুখচ্ছবি যখন ফুটে ওঠে তখন মনের গহীনে এক উদ্ভুত আনন্দের নাচন খেলে যায়। পাহাড়, বন-জঙ্গল, ছোট বড় ঝিরি ঝর্ণা পরিবেষ্টিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী জাঙ্গালিয়া।
উৎসাহী চোখ গিয়ে পড়ল পশ্চিম আকাশের লাল টকটকে অস্তমিত সূর্যের দিকে। ছোট্ট জীবনে বহু পাহাড়, পর্বত, সাগর, উপসাগর, নদী, খাল, বিল, হাওড়-বাওড় চষে বেড়িয়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে কখনও উঁকি দেয়নি যে, পাহাড়ের মাঝে সূর্যাস্ত দেখতে কেমন, পথের পাশে উঁচু টিলাতে একটি বাড়ি দেখতে পেলাম, গাড়ি থেকে নেমে অনুমতির অপেক্ষা না করে দৌড়ে বাড়ির পশ্চিম কোনে অবস্থান নিলাম, ততক্ষণে প্রায় ডুবু ডুবু। হায় সূর্য তোমার লাল আভা অবশেষে মনের মাঝে অতৃপ্ততার আগুন জ্বালিয়ে দিল। আবার দেখব সূর্যাস্ত এর চাইতেও উঁচু কোন স্থানে, হয়তো সেটা দেশের সর্বোচ্চ তাজিংডং (বিজয়) পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। ইতোমধ্যে বাড়ির লোকজনের সাথে পরিচয় হলো। বাড়িটি রতœা টি গার্ডেনের ম্যানেজারের বাংলো। ম্যানেজার সাহেবের সহধর্মিণীর মাধুর্যময় ব্যবহারে ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের প্রতিটি সদস্য মুগ্ধ। ধন্যবাদ তাকে ‘দে ছুট’-এর পক্ষ হতে।
ঘন বন, গভীর জঙ্গল, টিলার মধ্যে দিয়ে ঝিঁঝি পোকার মিটিমিটি আলো সঙ্গী করে গাড়ি চলছে। শ্রীমঙ্গলের দিকে না গিয়ে উপায় নেই, কারণ রাতের ১২.৩০ মি. ঢাকা যাওয়ার টিকেট সেখান থেকে কাটা, সেই সঙ্গে মানামা ফোম সেন্টারের মালিক বদরুল মামা সেই দুপুর থেকেই অপেক্ষা করতেছে, অগত্যা কলাউড়া থেকে না চড়ে শ্রীমঙ্গল থেকেই যেতে হবে ঢাকা। যে কুলাউড়া পিছনে ফেলে চলছি, সেই ছোট্ট শহরেও রয়েছে অনেক প্রাকঐতিহাসিক নিদর্শন। যার ইতিহাস ঐতিহ্য আপনার জ্ঞান ভা-ারকে সমৃদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে।
কুলাউড়া একের ভিতর অনেক। যেখানে অবস্থান করে আপনি বিল, হাওড়, টিলা, পাহাড়, ছড়া-ঝিরি, ঝর্ণা, জলপ্রপাত, বন, জঙ্গল, চা-বাগানসহ বহু স্থানে বেড়ানো সম্ভব। নির্মল প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে ঢাকা থেকে স্বল্প দূরত্বে অল্প খরচে ভ্রমণের জন্য আজই প্রয়োজনীয় তল্পিতল্পা গুটিয়ে মাত্র দু’দিনের জন্য ছুট দেন, সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভা-ার কুলাউড়া। বিদায়ের শেষ ঘণ্টা ঢং, ঢং, ঢং, ইস্টিশনের রেলগাড়িটা সবাইকে পেটে পুরে, ঝিকঝিক শব্দ তুলে বাইক্কা বিল ভ্রমণ বাকি রেখে চলছে ইঞ্জিন হুইসেল দিয়ে সমান্তরাল দু’লাইনে বাতাসে সীসাযুক্ত যান্ত্রিক শহর রাজধানী ঢাকার পথে।

No comments

Powered by Blogger.